Thursday, September 25, 2014

রাশিয়ার ওপর অবরোধে ঢাকাকে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ:কালের কন্ঠ

রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মতো অবরোধ আরোপ করতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। একই সঙ্গে রুশ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস হুঁশিয়ার করে বলেছে, অবরোধের তালিকায় স্থান পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কোনো বিদেশি কম্পানি ব্যবসা করলে সেই কম্পানির ওপরও অবরোধ আরোপ করা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস গত মাসে ঢাকায়
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি (ডিপ্লোম্যাটিক নোট) পাঠিয়ে এ কথা জানায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, গত কয়েক বছরে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত জোরদার হয়েছে। রাশিয়ার সহযোগিতায় এ দেশ রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ৭০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ১০০ কোটি ডলারের মাইলফলক অর্জনের পথে রয়েছে। বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে ১০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা ক্রয় চুক্তি রয়েছে। এর আওতায় বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে কম্ব্যাট এয়ারক্রাফটসহ সামরিক কার্গো বিমান কেনার বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে বলে জানা গেছে। গত মাসে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ইউক্রেন পরিস্থিতির কূটনৈতিক সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। রুশ সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, রাশিয়ার শুধু কথায় নয়, কাজের ভিত্তিতে ওই দেশটির বিষয়ে করণীয় ঠিক করা হবে। চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, উত্তেজনা প্রশমনে অঙ্গীকার সত্ত্বেও রাশিয়ার ইউক্রেন নীতিতে অর্থবহ কোনো উন্নতি যুক্তরাষ্ট্র দেখতে পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বলেছে, “ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ, ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার ‘অন্তর্ভুক্তকরণ’, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার চলমান লঙ্ঘন আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক বাধ্যবাধকতার ব্যত্যয় এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।” ওই চিঠিতে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গত ২৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যাংক অব মস্কো, রাশান অ্যাগ্রিকালচারাল ব্যাংক ও ভিটিবি ব্যাংকের ওপর অবরোধ আরোপের বিষয়টি উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ওই ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেন না করতে বলা হয়েছে। এর আগে ১৬ জুলাই গ্যাজপ্রম ব্যাংক ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন করপোরেশন ভিইবির বিরুদ্ধে অনুরূপ অবরোধ আরোপের কথাও উল্লেখ করা হয় ওই চিঠিতে। চিঠিতে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড শিপবিল্ডিং করপোরেশন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ওই কম্পানি ও কম্পানির অধীন ৫০ শতাংশ বা তার বেশি সম্পদের ওপর অবরোধ আরোপ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে না। ওই প্রতিষ্ঠানের পণ্য রপ্তানি, পুনঃরপ্তানি ও বিদেশে স্থানান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তরের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। চিঠিতে রাশিয়ার জ্বালানি খাতে এমন কয়েকটি পণ্য রপ্তানিতে লাইসেন্স না দেওয়ার নীতি গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে, যেগুলো গভীর জল, আর্কটিক সাগরের উপকূলবর্তী এলাকা এবং সম্ভাব্য তেল উৎপাদনের জন্য ‘শেল প্রজেক্টে’ ব্যবহার করা হতে পারে। রাশিয়ার বর্তমান জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে ব্যাহত করতে এবং যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশে রাশিয়ার তেল-গ্যাস বিক্রি বন্ধ করার লক্ষ্যে এ নীতি নেওয়া হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এ নীতির উদ্দেশ্য হলো- রাশিয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদে কারিগরিভাবে চ্যালেঞ্জিং ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি প্রকল্প গ্রহণ কঠিন করে তোলা। এ ছাড়া রাশিয়ায় রপ্তানি উৎসাহিত করে এমন ঋণপত্র ও দেশটিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন স্থগিত করার সিদ্ধান্তের কথাও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঢাকাকে জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস ওই চিঠিতে আরো বলেছে, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৩১ জুলাই তার অবরোধের নিজস্ব প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এগুলোর মধ্যে ইইউর পুঁজিবাজারে রাশিয়ার প্রবেশাধিকার সীমিত করা, রুশ তেল খাতে ব্যবহৃত নির্দিষ্ট কয়েকটি পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা, ইউক্রেনকে অশান্ত করতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা অন্যতম। আপনাদের সরকার (বাংলাদেশ) ইতিমধ্যে এ ধরনের কিছু করে না থাকলে, আমাদের (যুক্তরাষ্ট্র) ও অন্যদের (ইইউ) নেওয়া ব্যবস্থাগুলোর অনুরূপ ব্যবস্থার বিষয়টি বিবেচনা করতে আমরা আহ্বান জানাই।’ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক আইনের এসব লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আমাদের একসঙ্গে দাঁড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।’ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বলেছে, “কেবল রাশিয়াই তার ‘অবৈধ’ ও ‘অস্থিতিশীল’ কাজের মূল্য বুঝতে পেরে শোধরালে যুক্তরাষ্ট্র সফল হবে। একে অন্যের বিরুদ্ধে আমাদের খেলাতে পারে- রাশিয়ার এমন বিশ্বাস অবশ্যই ভাঙতে হবে।” ব্যবসা-লেনদেনে হুঁশিয়ারি : যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে এ দেশের কম্পানিগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের বিষয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ওই অবরোধ সম্পর্কে অবগত করতে ও সম্ভাব্য অবরোধ এড়াতে বাংলাদেশি কম্পানিগুলোকে তা জানানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের ওয়েবসাইটে (http://www.treasury.gov/about/ organizational-structure/offices/Pages/Office-of-Foreign-Assets-Control.aspx) অবরোধের শিকার কম্পানি ও ব্যক্তিদের হালনাগাদ তালিকা দেওয়া আছে। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বলেছে, ‘সব দেশ ও তাদের নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের তালিকায় স্থান পাওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেনের ঝুঁকি বিবেচনা করতে যুক্তরাষ্ট্র উৎসাহিত করে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছু কম্পানি অবরোধের তালিকায় স্থান পাওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেন করে লাভবান হওয়ার কথা ভাবতে পারে। এটি কোনোভাবেই আমাদের বরদাশত করা উচিত হবে না। কোনো কম্পানি এ ধরনের উদ্যোগ নিলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের গভীর উদ্বেগ থাকবে।’ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বলেছে, ‘অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন, যুক্তরাষ্ট্রের নয় এমন কম্পানিও অবরোধ আরোপ হওয়া ব্যক্তি বা কম্পানির পক্ষে কাজ করে বা পণ্য সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের শিকার হতে পারে।’ ভূরাজনৈতিক লড়াইয়ের উত্তাপ ঢাকাতেও : গত মার্চ মাসে ক্রিমিয়ার রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে গণভোটকে অবৈধ আখ্যায়িত করে আনা এক প্রস্তাবের বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটি হয়। এতে বাংলাদেশসহ ৫৮টি দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। তবে ১০০টি দেশ ওই প্রস্তাবের পক্ষে ও ১১টি দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়। গত ৩০ মার্চ ঢাকায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার এ নিকোলায়েভ ক্রিমিয়া ইস্যুতে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকায় বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান। তবে পরদিনই যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা ক্রিমিয়া ইস্যুতে ভোট দেওয়া থেকে বাংলাদেশ বিরত থাকায় দুঃখ প্রকাশ করেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ঠিক কাজই করেছে। বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতি থেকে বিচ্যুত হয়নি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর যুক্তি, ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) ও জি-৭৭-এর সদস্য হিসেবে আমরা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারো পক্ষ নিতে পারি না। আমরা সেই নীতি থেকেও বিচ্যুত হইনি। আর এ কারণে আমরা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছি।’ রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার এ নিকোলায়েভ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ক্রিমিয়াসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করে একে ‘কপটতা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। রাশিয়া তার জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে সচেতন হচ্ছে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করতেও পিছপা হননি রাষ্ট্রদূত নিকোলায়েভ। তাঁর মতে, অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত রাখার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের ভয় দেখানো বাড়াবাড়ি। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, অতীতে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বৈশ্বিক ও ভূরাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের সমর্থন চেয়েছে। তবে বাংলাদেশ তার নিজ অবস্থান ও পররাষ্ট্রনীতি বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইরান, মধ্যপ্রাচ্যসহ ভূরাজনৈতিক অনেক ইস্যুতে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। পশ্চিমা দেশগুলোও বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানে। দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের তথ্য মতে, রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বছরে ৫৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়াতে রপ্তানি করেছে ২০ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। ওই সময়ে রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৩ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। রাশিয়ায় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক নিটওয়্যার, চিংড়ি এবং পাট ও পাটজাত পণ্য। দেশটির বিশাল বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি শতগুণ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। রাশিয়া ২০০৯ সালে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছে, সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ সাড়ে ৫ শতাংশ । তবে বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছে সেখানকার ক্রেতারা। তৈরি পোশাকে রাশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ব্র্যান্ড ‘স্পোর্টস মাস্টার’ ২০০৯ সালে গুলশানে নিজস্ব একটি বায়িং হাউস খুলেছে। রাশিয়ায় বছরে চিংড়ির চাহিদা ৮৬ হাজার টন। সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ০.১ শতাংশেরও কম। ২০১০ সালে মস্কোতে বসে রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর নুর  মো. মাহবুবুল হক কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য দিয়ে বলেছেন,  নিটওয়্যার , চিংড়ি, সোয়েটার এবং পাট ও পাটজাত পণ্য- এই কয়েকটি পণ্য রাশিয়ার চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করতে পারলেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশ। ওই সময় রাশিয়ায় রপ্তানি বাড়াতে মস্কোতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের নিটওয়্যার রপ্তানিকারকরা। নিটওয়্যার রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি ও সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে রাশিয়ায় দিন দিন বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছে। এ অবস্থায় রাশিয়ার সঙ্গে বিভেদের মধ্যে বাংলাদেশকে জড়ানো যুক্তরাষ্ট্রের মোটেই উচিত হচ্ছে না। রাশিয়ার কোন কোন কম্পানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা আমরা এখনো জানি না। তবে সেসব কম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করলে আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট কম্পানির ওপর যদি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়, তা অবশ্যই আমাদের রপ্তানিসহ রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৯তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ও পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তাই যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ওই চিঠির বিষয়ে জানতে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এ চিঠিকে ‘আবদার’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছে, এটি ভূরাজনৈতিক বিরোধের অংশ। বাংলাদেশকে কোনোভাবেই এই স্রোতে গা ভাসানো উচিত হবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র যেমন বাংলাদেশের বন্ধু, তেমনি রাশিয়াও। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, রাশিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছে কোনোভাবেই বাংলাদেশের নতি স্বীকার করা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের এখন উচিত হবে অপেক্ষা করা ও বিশ্ব পরিস্থিতি দেখা। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশকে চাপে রেখেছে। এম শাহীদুজ্জামান বলেন, রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে অবরোধ আরোপ করেছে তা টিকবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আইসিসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। যদি যুক্তরাষ্ট্র তা না করে তবে আবারও শীতল যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামানের মতে, রাশিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্ক অত্যন্ত জোরালো। দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতার চুক্তিও হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশ কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়নি। কারণ এতে ওই অঞ্চলে রাশিয়ার স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটবে। এম শাহীদুজ্জামান বলেন, জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। অতীতে জাতিসংঘের বাইরের উদ্যোগে বাংলাদেশ নিজেকে জড়ায়নি। এবারও এ ধরনের চাপ থাকবে। কিন্তু তাতে নতি স্বীকার করা চলবে না। সময়ের সঙ্গে এই চাপ প্রশমিত হয়ে আসবে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক আহমেদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের আহ্বানে সাড়া দেওয়া এ দেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে কতটা যুক্তিযুক্ত তা সরকার নিশ্চয়ই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম মূল বিষয় হলো- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়। সাবেক রাষ্ট্রদূত শফি ইউ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাশা করে, তার বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলোও তাকে অনুসরণ করবে। যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারত্ব এখন বিশাল। এ কারণেই হয়তো যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে তার প্রত্যাশা জানিয়েছে। তবে আমি মনে করি না, এটা মানা এ দেশের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। কারণ এ অবরোধ জাতিসংঘ থেকে আসেনি। এখন এ দেশের নীতিনির্ধারকরা সম্ভাব্য উপায়গুলো দেখবেন। শফি ইউ আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক জোরালো, রাশিয়ার সঙ্গেও তেমনি। রাশিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের সম্পর্ক দিন দিন জোরালো হচ্ছে। শফি ইউ আহমেদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ মূলত আমেরিকানদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু অর্থনৈতিক কিছু বাধ্যবাধকতা আছে, যা অন্যদের জন্যও প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনা করে ব্যবসায়ীদের উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন একসময় মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে এ দেশের ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারতেন না। কিন্তু তাই বলে তো আর ব্যবসা থেমে ছিল না। অবরোধ থাকলে রাশিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যবসায়ীদের নতুন পথ খুঁজতে হবে।

No comments:

Post a Comment