সোনামসজিদ স্থলবন্দরে ভারত থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাকপ্রতি নির্ধারিত রাজস্বের বাইরে নেওয়া হয় ১৩০ রুপি। পণ্য খালাসের জন্য শ্রমিকদের ‘বকশিশ’ হিসেবে এ টাকা তোলা হয়। বন্দরে কর্মরত শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যয়ের শর্তে এ টাকা তোলার অনুমতি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে বাস্তবে আদায় করা হচ্ছে ২৩০ রুপি করে। এভাবে মাসে আদায় করা হচ্ছে অন্তত ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু নিয়ম ভেঙে বেশি টাকা আদায় করা হলেও শ্রমিক
দের ভাগে এর এক টাকাও জোটে না। সব টাকা যায় বন্দর নিয়ন্ত্রণকারী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও শ্রমিক সমন্বয় কমিটির (লীগ) নেতা এবং তাদের মদদ দেওয়া সরকারি দলের স্থানীয় সংসদ সদস্যদের পকেটে। সম্প্রতি বন্দর ঘুরে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এ চিত্র। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নিয়মানুযায়ী, সদস্যদের ভোটে দুই বছরের মেয়াদে সভাপতি-সম্পাদকসহ অন্য প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন। কিন্তু এ নিয়ম লঙ্ঘন করে পাঁচ বছর ধরে যখন যে এমপি বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন, তখন তাঁর পছন্দের লোকজনকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। নির্বাচন ছাড়াই মৌখিকভাবে কয়েক মাস পর পর কমিটি পরিবর্তন করা হয়। পাঁচ বছরে আটবার কমিটি বদল করা হয়েছে। বর্তমানে অ্যাসোসিয়েশনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের এমপি গোলাম রাব্বানি। তাঁর পছন্দের লোক সেনাউল হক চাঁদার টাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন। সেনাউল সোনামসজিদ শ্রমিক সমন্বয় কমিটির বর্তমান সভাপতি। এর বাইরে আছেন সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আখিরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি তাজুল ইসলাম। আখিরুল ও সেনাউল দুই ভাই। বন্দরে প্রতিদিন গড়ে ভারত থেকে পণ্যবাহী ট্রাক আসে ৩৩০টি। সে হিসাবে প্রতিদিন আদায় করা হচ্ছে ৭৫ হাজার ৯০০ রুপি (প্রায় এক লাখ ছয় হাজার টাকা)। এর বাইরে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি করা পণ্যবাহী ট্রাক থেকেও চলছে চাঁদাবাজি। প্রতিটি ফলের ট্রাক থেকে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। পাথর, ছাইসহ অন্য মালবাহী ট্রাক থেকে আদায় করা হয় ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা। এভাবে দিনে গড়ে অন্তত বাড়তি ২৫ হাজার টাকা চাঁদা আদায় হয়। সব মিলিয়ে মাসে ওঠে প্রায় ৪০ লাখ টাকা। বন্দরের নিয়মানুযায়ী, পণ্যবাহী ট্রাকে প্রতি টনে মাল তোলা বা খালাসের জন্য শ্রমিকদের মাত্র ১৫ টাকা দেয় কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকদের কথা বলে তোলা টাকার ভাগ নিয়ে শ্রমিক সমন্বয় কমিটি ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে অলিখিত চুক্তি রয়েছে। সে অনুযায়ী, ৫০ শতাংশ টাকা পাওয়ার কথা শ্রমিক সমন্বয় কমিটির, ২৫ শতাংশ পাওয়ার কথা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের। আর বাকিটা পাবে আদমানিকারকরা। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৮ সালে প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সোনামসজিদ স্থলবন্দরের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের ভাই নিজামুল হক রানার দখলে। নিজামুল সে সময় শিবগঞ্জের শাহাবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। সব টাকা তাঁর কাছেই জমা হতো। তিনি তা শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নিয়ন্ত্রণকারীদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন ইচ্ছামতো। বন্দর থেকে পাঁচ বছরে এভাবে অন্তত শত কোটি টাকা আদায় করেছেন তিনি। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম বলেন, উনিই (নিজামুল) সে সময় চাঁদার টাকার নিয়ন্ত্রণ করতেন। আমরা তাঁর ধারে কাছে ভিড়তে পারিনি।’ তবে এ ব্যাপারে কথা বলতে অনেক চেষ্টা করেও নিজামুলের নাগাল পাওয়া যায়নি। তাঁর মোবাইল ফোনসেটও বন্ধ পাওয়া গেছে। বন্দরের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর গত আট মাসের ব্যবধানেই কমিটি পরিবর্তন হয়েছে দুইবার। গত বছরের ১৭ এপ্রিল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আখিরুল ইসলাম ও সম্পাদক হারুন অর রশিদকে সরিয়ে সেখানে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুলের পছন্দের লোক হিসেবে তাজুল ইসলামকে সভাপতি ও তোহরুল ইসলাম টুটুলকে সম্পাদক করা হয়। তাঁরা প্রায় ১৩ মাস ক্ষমতায় থাকেন। এরপর বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আসনের এমপি আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস। তাঁর পছন্দের লোক শফিউর রহমান টানুকে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সভাপতি ও তাজুল ইসলামকে সম্পাদক করা হয়। এ কমিটি ক্ষমতায় ছিল তিন দিন। এরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ আসনের এমপি গোলাম রাব্বানি বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেন। গত ২০ মে তিনি নিজের পছন্দের লোক হিসেবে পরিচিত আখিরুল ইসলামকে সভাপতি ও তাজুল ইসলামকে সম্পাদক হিসেবে বসিয়ে দেন। ক্ষমতার দখল নিতে গিয়ে মাস তিনেক আগে সাবেক সভাপতি শফিউর রহমান টানুকে মারধরও করে আখিরুলের লোকজন। পরে টানুর লোকজন আখিরুলের ভাইকে মারধর করে। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি মামলাও হয় শিবগঞ্জ থানায়। যদিও উভয় পক্ষ মীমাংসা করে পরে মামলা দুটি প্রত্যাহার করে নেয়। শ্রমিক সমন্বয় (লীগ) কমিটিরও একই অবস্থা। বর্তমানে এ কমিটি নিয়ন্ত্রণ করছেন এমপি গোলাম রাব্বানির পছন্দের লোক হিসেবে পরিচিত সেনাউল ইসলাম। সভাপতি পদে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের পছন্দের লোক মোবারক হোসেনের পরিবর্তে গত ১৩ জুলাই সভাপতি করা হয় সেনাউল হককে। সাধারণ সম্পাদক করা হয় হারুন অর রশিদকে। প্রতি মাসে যে টাকা আদায় করা হচ্ছে তার ভাগ-বাটোয়ারার নিয়ন্ত্রণ এখন সেনাউলের হাতেই। তবে গোলাম রাব্বানি কালের কণ্ঠের কাছে দাবি করেন, ‘আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আর নিয়ন্ত্রণ নেই বলেই বন্দরের আমদানি এখন কমে গেছে। কেন কমে গেছে এটি জানতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু সেই কমিটিকেও কোনো সহযোগিতা করা হচ্ছে না প্রশাসন থেকে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন্দরের একাধিক শ্রমিক জানায়, শ্রমিকদের উন্নয়নের কথা বলে আদায় করা টাকা যায় বন্দর নিয়ন্ত্রণকারী এমপির লোকদের পকেটে। কেবল ঈদে কখনো কখনো শ্রমিকদের মধ্যে সেমাই-চিনি বা কাপড় বিতরণ করা হয়। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ‘দুই সংগঠনের নামে বন্দরে যে আয় হয়, তাঁর ২৫ শতাংশ আমাদের অ্যাসোসিয়েশনকে দেওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু বর্তমান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সেনাউল হক একাই সব টাকার নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি কাদের টাকা দেন, তা বলতে পারব না। তবে আমাদের কোনো টাকা দেন না। ফলে অ্যাসোসিয়েশনের আট কর্মচারীর বেতনও ঠিকমতো দেওয়া যাচ্ছে না।’ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি শফিউর রহমান টানু বলেন, ‘বন্দরের টাকা লুটপাটের জন্য এমপি গোলাম রাব্বানির নির্দেশে আখিরুল ইসলাম ও সেনাউল হককে সভাপতি করা হয়েছে। কোনো নির্বাচনও হয়নি। বন্দরের লাখ লাখ টাকার কোনো হিসাব নেই, যা উঠছে ভাগ-বাটোয়ারা করে সব লুটপাট করা হচ্ছে।’ তবে সেনাউল হক সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘টাকাগুলো দুই সংগঠনের মধ্যে সঠিকভাবেই বিতরণ করা হয়। আমি কোনো টাকা আত্মসাৎ করিনি। শ্রমিকদের অভিযোগও ঠিক নয়। আমার একক কোনো সিদ্ধান্তে এখানে কিছু বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আর ট্রাকপ্রতি বাড়তি কোনো টাকাও নেওয়া হচ্ছে না।’
No comments:
Post a Comment