Wednesday, September 24, 2014

পদ তৈরিতে ১৫০৬ নিয়োগে ২৬০১ দিন:কালের কন্ঠ

সরকারি চাকরির একটি পদ সৃজনে এক হাজার ৫০৬ দিন সময় লাগে। এসব নতুন পদ বা পুরনো শূন্যপদ পূরণে সময় লাগে আরো এক হাজার ৯৫ দিন। অর্থাৎ একটি পদ সৃজন থেকে চূড়ান্ত নিয়োগ দিতে দুই হাজার ৬০১ দিন বা ৮৬ মাস বা সাত বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। ৩০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সচিব কমিটিকে এসব তথ্য জানিয়েছে। তথ্যগুলো নিয়ে সচিব কমিটি গত সোমবার বৈঠকে বসেছিল। জানা গেছে, প্রশাসনিক স্থবিরতা ও রাজনৈতিক তদবিরবাজির কারণেই চাকরির বাজা
রে এ মন্দাদশার সৃষ্টি হয়েছে, যা থেকে বেকারত্বসহ নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে বলে সচিবরা মনে করছেন। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য পদ সৃজনের কোন ধাপে কত সময় ব্যয় করা যাবে, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই সরকারি চাকরির শূন্যপদ পূরণ, নতুন পদ সৃজন ও এসব পদে নিয়োগপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সচিব কমিটি গঠন করা হয়। মন্ত্রিপরিষদসচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব, অর্থসচিব, স্বাস্থ্যসচিব, লেজিসলেটিভ সচিব ও শিক্ষাসচিব। সমস্যার কারণ উদ্ঘাটন ও সমাধানের কৌশল বের করার জন্য আরো কয়েকটি বৈঠক তাঁদের করতে হবে। আসছে কোরবানির ঈদের পরপরই একটি সুপারিশপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হবে।  গত ২৪ এপ্রিল কমিটি গঠনের পরই সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে জানতে চাওয়া হয় সরকারি নিয়োগের সমস্যা কোথায়। ১০ দিনের মধ্যে একটি নির্ধারিত ফরম পূরণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রায় দুই মাস পর ৩০টি মন্ত্রণালয় তাদের মতামত জানায়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে পাঠানো তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তর থেকে পদ সৃজনের প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে সেই মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নিতে সর্বোচ্চ সময় লাগে ৪৫৫ দিন। এরপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পদ সৃজন করার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগে সময় লাগে পুরো এক বছর অর্থাৎ ৩৬৫ দিন। এরপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটির আর্থিক সংশ্লিষ্টতা বিবেচনায় নিয়ে অনুমোদন দেওয়ার জন্য পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এ মন্ত্রণালয়ের দুই শাখায় সময় লাগে ৫৪০ দিন। এর মধ্যে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ অনুবিভাগ সময় নেয় ৩৬০ দিন আর বাস্তবায়ন অনুবিভাগ সময় নেয় ১৮০ দিন। তিন মন্ত্রণালয় অনুমোদন করার পর বিষয়টিতে অনুমোদন দেয় প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটি। এ কমিটিতে সময় লাগে ৮৬ দিন। এরপর প্রস্তাবটি ফিরে যায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জিও বা সরকারি আদেশ জারির জন্য। মন্ত্রণালয় আবার এই জিও জারি করতেও সময় নেয় ৬০ দিন। সোমবারের বৈঠকে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এক হাজার ৫০৬ দিন পদ সৃজনের সর্বোচ্চ সময়। পদ সৃজনের গড় সময় আরেকটু কম। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয়) পদটি সৃজন করা হয়েছে মাত্র দুই দিনে। তবে ব্যতিক্রমকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে চান না তিনি। তিনি বলেন, ‘পদ সৃজনে এক হাজার ৫০৬ দিন কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এটা অবিশ্বাস্য। আজকের (সোমবারের) বৈঠকে অংশ নিয়ে মনে হয়েছে, এ দেশে কোনো কিছু সম্ভব নয়। কারণ পদ সৃজনে এক হাজার ৫০০ দিন লাগলে পদ পূরণে কমপক্ষে এক হাজার ৯৫ দিন বা তিন বছর লাগবে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারির পর থেকে তিন বছরের আগে কোনো চাকরিতে লোক নিয়োগ দেওয়া যায় না। কারণ মন্ত্রী ও এমপিদের তদবির। প্রতিটি পদের জন্য মন্ত্রীরা ডিও লেটার দেন। তাঁদের সঙ্গে আবার যোগ হয় এমপিদের ডিও।’ তিনি আরো জানান, ২০১২ সালে কোনো একটি মন্ত্রণালয়ে পিয়ন বা এমএলএসএস নিয়োগ দেওয়ার বিজ্ঞাপন জারি হয়। পাঁচটি পদের জন্য ২০ জন এমপি ডিও লেটার দিয়েছিলেন। মন্ত্রীর ডিও ছিল পাঁচটি। এ অবস্থায় কার সম্মান রক্ষা করা হবে সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় পুরো নিয়োগপ্রক্রিয়াই স্থগিত রাখা হয়েছে। সোমবারের বৈঠকে খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন একজন সচিব। তিনি জানান, খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ শেষ করতে সাত বছর লেগেছে। খাদ্য পরিদর্শক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। সেই নিয়োগ শেষ হয়েছে ২০১১ সালে। এরপর আওয়ামী লীগের গত মেয়াদে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব পদের নিয়োগেও তিন বছরের বেশি সময় লেগেছে। সোমবারের বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদসচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নানা কারণে পদ সৃজনে বেশি সময় লাগে। এটা কমিয়ে আনার উপায় বের করার জন্যই সচিব কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করবে। চূড়ান্ত সুপারিশ প্রস্তুত করার জন্য আরো কয়েকটি বৈঠক করতে হবে। আশা করছি, আগামী মাসে সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীকে দিতে পারব। পদ সৃজনের জন্য ধাপে ধাপে সময় লাগে। এই সময়টা নির্ধারণ করে দেওয়ার সুপারিশ করব। আর আলাদা কর্মকমিশনের বিষয়ে আমরা এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি। এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।’ বৈঠকে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পদ সৃজনে বিলম্বের ২০টি কারণ খুঁজে বের করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অর্থ বিভাগের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ অনুবিভাগ থেকে অনাপত্তি গ্রহণের পর পুনরায় ভেটিংয়ের জন্য একই মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন অনুবিভাগে যেতে হয়। একই মন্ত্রণালয়ের দুটি অনুবিভাগ থেকে আলাদা অনুমোদন নেওয়ার কারণেই এত বিলম্ব হয়। প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় (যে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রস্তাবটি সংশ্লিষ্ট) যে প্রস্তাব পাঠায়, সেই প্রস্তাব পূর্ণাঙ্গ হয় না। তথ্য-উপাত্ত হালনাগাদ থাকে না। পদ সৃজনপ্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব রয়েছে। জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পাওয়াতেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। সৃজনপ্রক্রিয়ায় যেসব কর্মকর্তা জড়িত তাঁদের প্রশিক্ষণ নেই। প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির অনুমোদনের পর প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিতে হয়। আগের পদ সৃজনের অফিস আদেশ চাওয়া হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তা দিতে পারে না। এ ছাড়া সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব পদমর্যাদার পদ সৃষ্টি করতে হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তিনটি শাখা থেকে আলাদা অনুমোদন নিতে হয় বলে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়। বৈঠকে জনবল নিয়োগ কার্যক্রমও পর্যালোচনা করা হয়েছে। সংসদের সদ্য সমাপ্ত অধিবেশন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক জানিয়েছেন, বর্তমানে সরকারের প্রায় দুই লাখ ২৯ হাজার শূন্যপদ রয়েছে। এসব পদে জনবল নিয়োগ দিতে কেন বিলম্ব হয় জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা বলেন, যে ৩০টি মন্ত্রণালয় মতামত পাঠিয়েছে সেখানেই এর কারণ ব্যাখ্যা করা আছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সুপারিশে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয় বা বিভাগের যোগ্য প্রার্থী না থাকলে শূন্যপদে নিয়োগ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। নিয়োগ লাভের জন্য মনোনীত প্রার্থীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন পেতেও দেরি হয়। মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে যে ব্যয় হয়, তার বরাদ্দ পাওয়া যায় না। লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাড়া না পাওয়াও আরেক সমস্যা। আবার মামলায় জড়িয়ে অনেক পরীক্ষা আটকে যায়। সময় বেশি লাগার কারণে কিছু পদ পূরণ করা যায় না। মৌখিক পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করতে সময় লেগে যায়। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পাওয়াদের সনদ যাচাই-বাছাইয়েও অনেক সময় লেগে যায়। বিভিন্ন কোটা ঠিক রাখতে গিয়ে সময় বেশি লাগে। এসবের সঙ্গে কোনো কারণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশ প্রয়োজন হলে তাতেও সময় বেশি লাগে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশ পেতে সর্বোচ্চ ৭৩০ দিন সময় লাগার কথা জানিয়েছে একটি মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ করেছে। শুধু মেধা কোটায় নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ এসেছে। বলা হয়েছে, পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদন ত্বরান্বিত করা দরকার। অনলাইনে আবেদন করার সুযোগ দিলে জটিলতা কমবে বলে মতামত পাওয়া গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো পুল পদ্ধতি চালু করার সুপারিশ উঠেছে। জনবল নিয়োগে ছাড়পত্র নেওয়ার পদ্ধতি বিলুপ্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে একটি মন্ত্রণালয়। পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়োগের পর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণির পদগুলোতে পদোন্নতিযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সরাসরি নিয়োগের বিধান করারও প্রস্তাব এসেছে। নিয়োগ বিধিমালার জন্যও নিয়োগে বিলম্ব হয় বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এ বিধি করার জন্য বছরের পর বছর ফাইল পড়ে থাকে। প্রবিধানমালার জন্যও নিয়োগপ্রক্রিয়া আটকে থাকে। প্রবিধানমালা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ে সর্বোচ্চ ৩৮০ দিন আটকে থাকার নজিরও রয়েছে। নাম প্রকাশে নারাজ একজন সচিব কালের কণ্ঠকে বলেন, একটি পূর্ণমেয়াদি সরকার পাঁচ বছরে বিদায় নেয়। অথচ এ সময়ের মধ্যে চাইলেও কোনো নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করা সম্ভব হয় না। আর পদ সৃজনের পর চলে মন্ত্রী-এমপিদের দৌরাÍ্য। বিগত মহাজোট সরকারের একজন মন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে ওই সচিব বলেন, মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি নির্ধারিত অধিদপ্তরে সাড়ে তিন শ লোক নিয়োগের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করার পর সব পদে লোক নিয়োগের ইচ্ছার কথা জানান মন্ত্রী। বিষয়টিকে সচিব প্রথমে হাসি-ঠাট্টার সঙ্গে উড়িয়ে দিলেও মন্ত্রীর কড়া নির্দেশ আসে যে তাঁর তালিকার বাইরে কাউকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে সচিবদের একটি ফোরামে আলোচনা হয়। বিষয়টি ফয়সালা করার জন্য অন্য মন্ত্রণালয়ের একজন মন্ত্রীর সহায়তাও নেওয়া হয়।  

No comments:

Post a Comment