Thursday, September 18, 2014

চাপা অসন্তোষ সন্দেহ:কালের কন্ঠ

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, যত দিন সাঈদীর স্বাভাবিক মৃত্যু না হবে তত দিন তাঁকে কারাগারে থাকতে হবে। গতকাল বুধবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে বেঞ্চের অন্য সদস্যরা ছিলেন- বিচারপতি সুরেন্দ্র
কুমার (এস কে) সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে এ রায় দেওয়া হলো। তবে এ রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সন্তান, বুদ্ধিজীবী, লেখক-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষকসহ বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা। রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই তাঁরা জানান, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বহুমাত্রিক দায় যাঁর, তাঁর আমৃত্যু কারাদণ্ড তাঁদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এ রায়ের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদ পরিবার এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারকেও উপহাস করা হয়েছে; অপমান করা হয়েছে এবং তাদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। পাশাপাশি বিশিষ্টজনরা রাষ্ট্রপক্ষের সমালোচনা করে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে নানা মহলে আঁতাত ও আপসের বিষয়ে জনমনে যে সন্দেহ ও উৎকণ্ঠা দীর্ঘদিন ধরে দানা বাঁধছে, এ রায়ের মাধ্যমে তা আরো বাড়বে। এ ছাড়া রায় ঘোষণার পর শাহবাগে জমায়েত হওয়া গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুলিশ তাদের লাঠিপেটার পাশাপাশি কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে। গণজাগরণ মঞ্চ থেকে তিন দিনের প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। এ রায়ের পর কোনো পক্ষ রিভিউ আবেদন করতে পারবে কি না সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। এর আগে জামায়াতের আরেক নেতা আবদুল কাদের মোল্লার মামলায়ও একই প্রশ্ন উঠেছিল। তখন কাদের মোল্লার আইনজীবীরা রিভিউ আবেদন দাখিল করেছিলেন। আদালত এ আবেদন শুনানির পর খারিজ করে দেন। আপিল বিভাগের এ আদেশের কপি আজও প্রকাশিত হয়নি। ফলে রিভিউ করা যাবে কি না সে প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়েই যাচ্ছে, যদিও দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, রিভিউ করার সুযোগ নেই। তবে সাঈদীর আইনজীবী ও পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর রিভিউ আবেদন করা হবে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পিরোজপুরের ‘দেইল্লা রাজাকার’ নামে খ্যাত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিলের রায় ঘোষণার তারিখ আগের দিন নির্ধারণ করা হয়। গতকাল সকাল ১০টা ৫ মিনিটে রায় ঘোষণার জন্য আপিল বিভাগের এক নম্বর বেঞ্চের সদস্যরা প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এজলাসে ওঠেন। দুই-তিন মিনিটের মধ্যে রায়ের মূল অংশটুকু পাঠ করে রায় ঘোষণা শেষ করেন তাঁরা। এরপর দৈনন্দিন কার্যতালিকায় থাকা অন্য মামলার শুনানি গ্রহণ করেন আদালত। এর আগে গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর কাদের মোল্লার মামলায় ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের রায় ঘোষণা করা হয়। ওই মামলায় ট্রাইব্যুনালের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ বাতিল করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল মঞ্জুর করে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। গত বছর ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকরও হয়। এর এক বছরের মাথায় আপিল বিভাগের দ্বিতীয় মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায় পরিবর্তন করে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হলো। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সাঈদীর পক্ষে ও রাষ্ট্রপক্ষে দুটি আপিল করা হয়েছিল। সাঈদী খালাস চেয়ে এবং সরকারপক্ষ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত অভিযোগে শাস্তি চেয়ে আপিল করে। উভয় আপিলের আংশিক মঞ্জুর করা হয়েছে বলে রায় ঘোষণার সময় প্রধান বিচারপতি উল্লেখ করেন। সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ৩০টি অভিযোগ উত্থাপন করে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল ২০টি অপরাধ আমলে নিয়ে ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত রায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রাষ্ট্রপক্ষের আনা ২০টি অভিযোগের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল আটটিতে সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করেন। এর মধ্যে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিশাবালী নামের দুজনকে হত্যার দায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দুটি অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় অন্য ছয়টিতে কোনো সাজা দেননি ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ে বলা হয়েছিল, যেহেতু দুটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হলো, কাজেই অন্য প্রমাণিত অপরাধগুলোর দায়ে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অন্য ১২টি অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে না পারায় সেগুলো থেকে সাঈদীকে খালাস দেওয়া হয়। আপিল বিভাগের গতকালের রায়ে ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত ওই আটটি অভিযোগের মধ্যে আরো তিনটি অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দেওয়া হয়। বাকি পাঁচটি অভিযোগের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে বিভিন্ন মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পাঁচটির মধ্যে তিনটিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড, একটিতে ১০ বছরের ও আরেকটিতে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। রায়ে আদালত যা বলেন : আপিলের নম্বর উল্লেখ করে আদালত বলেন, আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের উভয় আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হলো। এরপর বলেন, সাঈদীর বিরুদ্ধে ৭ নম্বর অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় তাঁকে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, ৮ নম্বর অভিযোগ আংশিক প্রমাণ হওয়ায় তাঁকে ১২ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হলো। অন্যদিকে ৮ নম্বর অভিযোগের দুটি অপরাধের একটি থেকে এবং ৬, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হলো। অভিযোগ প্রমাণে ট্রাইব্যুনাল-আপিল বিভাগে ফারাক : ট্রাইব্যুনাল ৭ নম্বর অভিযোগে সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করলেও কোনো সাজা দেননি। তবে এই অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় আপিল বিভাগ সাঈদীকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। এই অভিযোগে বলা হয়েছিল, ১৯৭১ সালের ৮ মে দুপুর দেড়টায় পিরোজপুর সদর থানার ভাদুরিয়া গ্রামে নুরুল ইসলাম খানের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নুরুল ইসলামকে ধরে নিয়ে সাঈদী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন এবং ওই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে তা ধ্বংস করেছিলেন। ৮ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। এই অভিযোগে দুটি অপরাধ প্রমাণিত হয়েছিল। আপিল বিভাগ সাঈদীর আপিল আংশিক মঞ্জুর করে একটি অভিযোগে সাঈদীকে খালাস দেন; অন্যটিতে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেন। এই অভিযোগে বলা হয়েছিল, একই দিন বিকেল ৩টায় পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় চিতলিয়া গ্রামের মানিক পসারীর বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁর ভাই মফিজ উদ্দিন ও ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পাঁচটি বাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সাঈদী চিনিয়ে দেওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী ইব্রাহিমকে গুলি করে হত্যা করে। এ ছাড়া পারেরহাট বন্দরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে সাঈদীর নেতৃত্বে আগুন দেওয়া হয়। ১০ নম্বর অভিযোগ ছিল- ওই বছরের ২ জুন সকাল ১০টায় সাঈদীর নেতৃত্বে তাঁর সহযোগীরা উমেদপুর হিন্দুপাড়ায় চিত্তরঞ্জন তালুকদার, জহর তালুকদার, হারেন ঠাকুর, অনীল মণ্ডল, বিশাবালী, সুকাবালী, সতিশ বালার বাড়িসহ ২৫টি বাড়িতে হামলা চালায়। বিশাবালীকে নারিকেলগাছের সঙ্গে বেঁধে হত্যা করা হয়। এই অভিযোগ সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। আপিল বিভাগেও অভিযোগটি প্রমাণিত হওয়ায় সাঈদীকে সাজা দেওয়া হয়, তবে মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন সর্বোচ্চ আদালত। ১৬ নম্বর অভিযোগ সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রমাণিত হলেও ট্রাইব্যুনাল তাঁকে সাজা দেননি। তবে আপিল বিভাগ এই অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এই অভিযোগে বলা হয়, পারেরহাট বন্দরের উমেদপুরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাঁর তিন বোন মহামায়া, অন্যরানী ও কমলা রানীকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেন সাঈদী। তাঁরা টানা তিন দিন সেখানে ধর্ষণের শিকার হন। ১৯ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আপিল বিভাগ সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। কিন্তু এই অভিযোগ প্রমাণিত হলেও ট্রাইব্যুনাল তাঁকে কোনো শাস্তি দেননি। এই অভিযোগে বলা হয়, স্বাধীনতাযুদ্ধকালে মধুসূদন ঘরামী, কৃষ্ট সাহা, ডা. গণেশ সাহা, অজিত কুমার শীল, বিপদ সাহা, নারায়ণ সাহা, গৌরাঙ্গ পাল, সুনীল পাল, নারায়ণ পাল, অমূল্য হালদার, শান্তি রায়, হরি রায় জুরান, ফকির দাস, টোনা দাস, গৌরাঙ্গ সাহা, হরিদাস, গৌরাঙ্গ সাহার মা ও তিন বোন- মহামায়া, অন্যরানী ও কমলা রানীসহ ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরিত করেন সাঈদী ও তাঁর সহযোগীরা। তিনটি অভিযোগ থেকে রেহাই : সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নম্বর ৬, ১১ ও ১৪ প্রমাণিত না হওয়ায় আপিল বিভাগ তাঁকে খালাস দেন। এই তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন, তবে কোনো শাস্তি দেননি। ৬ নম্বর অভিযোগ ছিল- ১৯৭১ সালের ৭ মে শান্তি কমিটির একদল লোক নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পারেরহাট বাজারে আওয়ামী লীগ নেতা, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এবং স্বাধীনতার সমর্থকদের দোকান ও বাড়িঘরে হামলা চালান সাঈদী। মুকুন্দ লাল সাহার দোকান থেকে ২২ সের সোনা ও রুপা লুট করেন। ১১ নম্বর অভিযোগ ছিল- ২ জুন টেংরাখালীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁর ছোট ভাই আব্দুল মজিদ হাওলাদারকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করেন সাঈদী ও তাঁর লোকজন। ধরে নেওয়ার সময় নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান সম্পদ লুট করা হয়। ১৪ নম্বর অভিযোগ ছিল- স্বাধীনতাযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ৫০ থেকে ৬০ জন রাজাকার হোগলাবুনিয়ায় হিন্দুপাড়ায় হামলা চালায়। সেখানে ১ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে হোগলাবুনিয়া গ্রামের মধুসূদন ঘরামীর স্ত্রী শেফালী ঘরামীকে আটক করে ধর্ষণ করা হয়। আদালতের পরিবেশ : আপিলের রায় শুনতে গতকাল বিপুলসংখ্যক আইনজীবী, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তি আদালতে হাজির হন। একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতির আরদালি এজলাসে আসেন। তাঁকে দেখে সবাই নড়েচড়ে বসেন। কিন্তু তিনি এসে বিচারপতির টেবিল থেকে মামলার নথিপত্র নিয়ে আবার ভেতরে চলে যান। এর পরও কিছু সময় চলে যায়। আদালত কক্ষের দেয়ালে রক্ষিত ঘড়িতে যখন ১০টা ৫ মিনিট, তখনই একে একে এজলাসে আসেন প্রধান বিচারপতিসহ পাঁচ বিচারপতির আরদালিরা। তখন সবাই দাঁড়িয়ে যান। এরপর প্রবেশ করেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতি। তাঁরা আসন গ্রহণ করার পর প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ডান পাশে বসা বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে কথা বলেন। এরপর বেঞ্চ অফিসার মামলার কার্যতালিকা ধরে ডাকেন। বেঞ্চ অফিসারের ক্রমিক উচ্চারণের পর প্রধান বিচারপতি রায় পড়তে থাকেন। যে তিনটি অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দেন আপিল বিভাগ, সেই তিনটির রায় প্রথমেই উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি। এরপর একে একে সাজার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় ঘোষণা করা হচ্ছে। রায় ঘোষণা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আইনজীবী ও সাংবাদিকরা দাঁড়িয়ে যান। তখনো বিচারপতিরা এজলাসে বসা ছিলেন। এরপর সাংবাদিক, সাঈদীর মামলাসংশ্লিষ্ট আইনজীবী ও নিরাপত্তাকর্মীরা আদালত কক্ষ ত্যাগ করেন। তখনো অন্য মামলা থাকায় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে অন্য বিচারপতিরা এজলাসে বসা ছিলেন। রিভিউ আবেদন করা হবে : সাঈদীর আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সাজা কমিয়ে আমৃত্যু দণ্ডাদেশ দেওয়াটা রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই নয়। এ রায়ে ন্যায়বিচার পাননি সাঈদী। আমরা এ রায় পর্যালোচনা করে রিভিউ আবেদন করব। আশা করি, রিভিউ আবেদনে সাঈদী ন্যায়বিচার পাবেন।’ তিনি বলেন, সাজা কমিয়ে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়ায় আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে।   সাঈদীর আরেক আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, আশা করি, রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানির পর সাঈদী ন্যায়বিচার পাবেন এবং বেকসুর খালাস পাবেন। সাঈদীর ছেলে ও পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলা চেয়ারম্যান মাসুদ বিন সাঈদী গতকাল রায় ঘোষণার পর আপিল বিভাগ থেকে বেরিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার পিতা নিরপরাধ। প্রত্যাশা করেছিলাম তিনি খালাস পাবেন। কিন্তু তা হয়নি। আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। তাই রিভিউ আবেদন করব। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পাওয়ার পর রিভিউ করা হবে।’ ক্ষোভ হতাশা অসন্তোষ : রায় শোনার পর আদালত থেকে বেরিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এ রায় নিয়ে কারো প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। সবার মেনে নেওয়া উচিত। তবে আমাদের প্রত্যাশা ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকবে।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আদালত যখন রায় দিয়েছেন, তার প্রতি আমরা শ্রদ্ধা রাখি। এখানে খুশি বা না খুশি হওয়ার কিছুই নেই।’ তুরিন আফরোজ বলেন, ‘আমরা এই মুহূর্তে পূর্ণাঙ্গ রায় পাইনি, সুতরাং আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয় কী ব্যাখ্যা বা কারণে সাঈদীর সাজা কমানো বা বাড়ানো হয়েছে। রায়ের কপি পেলেই আমরা তা বলতে পারব।’ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর রায় হয়েছে, কিন্তু মানুষের মুখের দিকে তাকালে মনে হয় সবাই মর্মাহত।’ প্রবীণ সাংবাদিক কামাল লোহানী বলেন, ‘এ রায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের কোটি মানুষের মনে ক্ষোভ সঞ্চার করেছে।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আশা করেছিলাম ট্রাইব্যুনালে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে যে রায় হয়েছিল, অপিল বিভাগে তা বহাল থাকবে। কিন্তু তা হলো না। এ রায় আমাদের বেদনাহত করেছে।’ রায়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান কে এম সফিউল্লাহ। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের এস ফোর্সের প্রধান সফিউল্লাহ বলেন, ‘এ রায়ে আমরা হতাশ। এতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি।’ শহীদ আলতাফ মাহমুদের সন্তান শাওন মাহমুদ বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর এ রায়ে আমরা অসহায় বোধ করছি। এ রায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দ্বিধার মধ্যে ফেলে দেবে।’ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ ধরনের রায় মানতে কষ্ট হয়। আপনারা জানেন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও কেন তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হলো না তা আমাদের অনেকটা দোলাচলে ফেলে দিল।’ নাট্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, ‘এ রায়ে আমার মনে হলো গুরুপাপে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সাঈদীকে।’ নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘আমি হতাশ।’ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দীন ইউসুফ ও সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, ‘আজ আমরা সংক্ষুব্ধ ও অপমানিত বোধ করছি।’ একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নেতারা গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, একাত্তরের চিহ্নিত খুনি, নারী নির্যাতনকারী রাজাকার সাঈদীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় কমিয়ে আমৃত্যু কারাবাসের যে আদেশ দেওয়া হয়েছে তা গণমানুষের প্রত্যাশার পরিপন্থী। এই রায় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্তদের হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন কামাল লোহানী, অজয় রায়, হাসান আজিজুল হক, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, হামিদা বানু, রবিউল হুসাইন, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, মমতাজ লতিফ, কাজল দেবনাথ, শামীম আখতার, শহীদজায়া সালমা হক, আরমা দত্ত, আবুল র্বাক আল্ভী, শিরিন বানু মিতিল, কাজী মুকুল, জুলফিকার আলী মাণিক, ফজলুর রহমান, তুরিন আফরোজ, সাব্বির রহমান খান, সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ, কাজী লুৎফর রহমান, আলী আকবর, গাজী সালাহউদ্দীন, ডা. শাফিকুল আলম, ডা. শেখ বাহারুল আলম, আবদুর রব, ডা. নুজহাত চৌধুরী, বায়েজিদ আক্কাস, মহেন্দ্রনাথ সেন, শওকত বাঙালি প্রমুখ।

No comments:

Post a Comment