রাজধানীর বনানীর একটি বাসা থেকে পুলিশ শিল্পপতি দম্পতির গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে। তাঁরা হলেন আব্দুর রউফ (৬০) ও তাঁর স্ত্রী রোকসানা পারভীন (৪৫)। গতকাল সোমবার রাতে নিজেদের শয়নকক্ষেই তাঁদের মরদেহ পাওয়া যায়। আব্দুর রউফ আফছার গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন। গভীর রাত পর্যন্ত পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। ঘরের ভেতরে পড়ে থাকা গুলিভর্তি পিস্তল ও ব্যবহৃত দুটি গুলির খোসা জব্দ করা হ
য়েছে। প্রাথমিকভাবে পুলিশ সন্দেহ করছে, লাইসেন্স করা পিস্তলে আব্দুর রউফ স্ত্রীকে হত্যার পর আত্মহত্যা করেছেন। তবে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো মত দেননি কর্মকর্তারা। লাশের ময়নাতদন্ত ও আগ্নেয়াস্ত্রের ফরেনসিক প্রতিবেদন পাওয়ার পরই এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা মিলবে বলে জানিয়েছেন উপস্থিত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। পুলিশের গুলশান জোনের উপকমিশনার লুৎফুল কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্ট থানার মাধ্যমে সন্ধ্যার একটু পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছি। ভেতরে ঢুকে দেখি নিজ ফ্ল্যাটের শয়নকক্ষে খাটের ওপর উপুর হয়ে পড়ে ছিলেন রোকসানা পারভীন। রক্তের দাগও স্পষ্ট ছিল। পরে বোঝা যায় তাঁর পেটের নিচের অংশে গুলি লেগেছে। আব্দুর রউফের মরদেহ ছিল দেয়ালের পাশে, মাথা দেয়ালে হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিল। পাশেই পড়ে ছিল পিস্তল। দুটি গুলির খোসাও ছিল। গতকাল বাসায় ছিল ওই দম্পতির ছোট মেয়ে ও গৃহকর্মী। তবে তাদের বক্তব্য থেকে ঘটনা সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তারা তখন ফ্ল্যাটের বাইরে ছিল বলে জানা গেছে।’ রাতে ক্যান্টনমেন্ট থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছার পর আলামত সংগ্রহের জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপির) ক্রাইম সিন ইউনিটকে তলব করে। মধ্যরাত পর্যন্ত পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে সব কাজ তদারক করেন। ফ্ল্যাটটিতে নিহত দম্পতির ঘনিষ্ঠ স্বজন ছাড়া সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। বনানীর ৫ নম্বর রোডের ৬০/এ নম্বরে অবস্থিত ছয়তলা বাদরিয়া রশিদ ভবনের ৪-এ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকতেন আব্দুর রউফ ও রোকসানা পারভীন। ভবনটি বনানী ডিফেন্স অফিসার্স হাউজিং সোসাইটির (ডিওএইচএস) অন্তর্ভুক্ত। সেখানকার নিরাপত্তা পরিচালক কামরুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা আত্মহত্যার ঘটনা বলেই জেনেছি। আবাসিক এলাকাটিতে রয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিজস্ব তল্লাশি চৌকি রয়েছে। এ অবস্থায় ভবন ও ফ্ল্যাটে কোনো অস্ত্রধারী ব্যক্তির ঢোকা ও বের হয়ে যাওয়া কঠিন। এ ফ্ল্যাটে বহিরাগত কারো প্রবেশের তথ্য এখনো জানতে পারিনি।’ পুলিশ জানিয়েছে, আব্দুর রউফ শিল্পপ্রতিষ্ঠান আফছার গ্রুপের মালিক বলে জানা গেছে। তাঁর স্ত্রী ওই গ্রুপের পরিচালক ছিলেন। ব্যবসায় বিস্তর লোকসান ও ব্যাংক ঋণের কারণে স্ত্রীর সঙ্গে রউফের প্রায়ই কলহ হতো বলে স্বজনরা জানিয়েছেন। কিন্তু তার জের ধরে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে- এ রকমটা স্বজনদের কেউ আশঙ্কা করেননি। ওই দম্পতির শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম ও অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য না জানাতে পারলেও পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, আব্দুর রউফের বাবার নাম আফছার আহমেদ। দুই ভাইয়ের মধ্যে আলাউদ্দিন আহমেদ ১৯৯১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। আফছার গ্রুপ পরিচালনার পাশাপাশি পুরো সংসারের দায়িত্ব পড়ে রউফের ওপর। রোকসানার বাড়ি খুলনায়। মেডিক্যালের ছাত্রী থাকা অবস্থায় রউফের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। শিক্ষিত স্ত্রীর পরামর্শকেই প্রাধান্য দিতেন তিনি। পারিবারিক ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফতুল্লার আফছার অয়েল মিল, সোনালী টোব্যাকো লিমিটেড ২০০১ সালে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেন রউফ। এর বাইরে জাহাজ ও সিমেন্টের ব্যবসাতেও লোকসানে পড়েন। প্রচুর ব্যাংক ঋণ তিনি সামাল দিচ্ছিলেন নানা কৌশলে। তা নিয়ে দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি হয় এবং আব্দুর রউফ সম্প্রতি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। স্বজনরা জানায়, আব্দুর রউফের বড় ছেলে নাসির আহমেদ তাবলিগ-জামাত করে সময় কাটান। তিনি ব্যবসায়ে মনোযোগী ছিলেন না। মেজ ছেলে নাঈম আহমেদ বাবাকে কিছুটা সহযোগিতা করতেন। ছোট ছেলে নাজিব আহমেদ ও মেয়ে সোনালী আহমেদ কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থী। গুলশানের ৯৫ নম্বর রোডে আব্দুর রউফের একটি বাড়ি রয়েছে। সেখানে তাঁর মা ও ছেলেরা থাকেন। রউফ স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে থাকতেন বনানীর ফ্ল্যাটে। মা-বাবার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে রাত ৯টার দিকে বনানীর বাসায় আসেন নাঈম আহমেদ। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘বাবার ব্যবসায়িক মন্দার কথা জানতাম। ঋণ ও লোকসানের কারণে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। বিভিন্ন আর্থিক বিষয় নিয়ে বাবা-মায়ের তর্ক হতো। কিন্তু তার ফলে এমন হবে তা কল্পনা করতে পারিনি। এখন পুলিশ তদন্ত করে দেখবে কিভাবে ঘটনা ঘটেছে। আমাদের এ বিষয়ে তেমন কোনো ধারণা নেই।’ আব্দুর রউফের বন্ধু ইকবাল হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘদিন একসঙ্গে ছিলাম। আগে রউফের পরিবারের লবণ, তেলসহ সিমেন্ট ব্যবসায় ব্যাপক দাপট ছিল। এখন সব উধাও। এ নিয়ে রউফ খুব অশান্তিতে ছিলেন। তবে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালো ছিল।’ প্রতিবেশী জাহিদ হাসান বলেন, ‘সন্ধ্যায় একটা গুলির শব্দ শুনেছি। কিন্তু কোথায় হয়েছে তা বুঝতে পারিনি। পরে পুলিশ আসলে ঘটনা জানতে পারি। কোনো হৈচৈ ও উত্তেজনার বিষয় আমরা জানি না।’ পুলিশের ক্যান্টনমেন্ট জোনের সহকারী কমিশনার মাশরুফ হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, বাড়ির একটি কক্ষে স্বামী-স্ত্রীর মরদেহ পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে তাঁদের মৃত্যুর ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা সম্ভব হয়নি। প্রতিবেশীসহ নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে তা জানার চেষ্টা চলছে। তবে বাসাটিতে অস্ত্রধারী কারো প্রবেশের কথাও জানা যায়নি। ওই ফ্ল্যাটের গৃহকর্মী ফিরোজা বেগম (৪০) পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি দুপুরের পর একবার নিচে গেলেও পরে ঘরেই ছিলেন। কানে কম শোনার কারণে তেমন কোনো আওয়াজ বুঝতে পারেননি। আর না ডাকলে তিনি গৃহকর্তার ঘরে যেতেন না। নিহত দম্পতির মেয়ে সোনালী আহমেদ (১৪) ঘটনার সময় বাসায় ছিল না। ফিরেই এ দৃশ্য দেখে বলে পুলিশকে জানিয়েছে। গতকাল মধ্যরাত পর্যন্ত র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানসহ ঢাকা মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আজ মঙ্গলবার লাশের ময়নাতদন্ত করতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে। গত বুধবার রাতে পূর্ব রাজাবাজারের নিজ বাসায় খুনের শিকার হন ইসলামী চিন্তাবিদ ও টেলিভিশনে ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক নূরুল ইসলাম ফারুকী। তাঁকে ড্রয়িংরুমে জবাই করার পর খুনিরা নির্বিঘ্নে চলে যায়। এর পরদিনই মগবাজারের বাসায় ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে অস্ত্রধারীরা হত্যা করে এক স্কুলশিক্ষিকাসহ তিনজনকে। এসব ঘটনার রেশ না কাটতেই শিল্পপতি দম্পতির গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটল।
No comments:
Post a Comment