কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলায় বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৬৫ হাজার। ১০ দিন ধরে এসব মানুষ বাস করছে বন্যার পানির সঙ্গে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত তাদের জন্য উপজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় থেকে বিতরণ করা হয়েছে ২০ টন বা ২০ হাজার কেজি চাল। সে হিসাবে মাথাপিছু চাল পড়েছে আধাকেজির চেয়ে কম। অথচ চাল দেওয়া হয়েছে পাঁচ কেজি করে। সে হিসাবে অধিকাংশ মানুষই ত্রাণপ্রাপ্তির বাইরে থেকে গেছে। মোটামুটি এভা
বেই দিন কাটছে বিভিন্ন জেলার বন্যাকবলিত মানুষের। নগদ টাকা নেই, রোজগার নেই- এসব মানুষ এখন কাজ চাচ্ছে। সাংবাদিক দেখলেই বলছে, ‘ত্রাণ চাই না, কাজ চাই।’ তবে এখন পর্যন্ত বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে বন্যাকবলিত অধিকাংশ জেলাতেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ভাঙা বাঁধ আরো বড় হয়ে দু-একটি স্থানে নতুন করে প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বন্যার পানিতে ডুবে গতকাল কুড়িগ্রাম, হবিগঞ্জ, শেরপুর ও বগুড়ায় শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদ- নীলফামারী : নীলফামারীতে তিস্তার পানি গতকাল চতুর্থ দিনের মতো বিপৎসীমার নিচে নামতে থাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে দুর্ভোগ কমেনি জেলার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার বন্যাকবলিত মানুষের। বন্যা-পরবর্তী এসব মানুষের মাঝে সংকট বিরাজ করছে খাদ্য আর কর্মসংস্থানের। সরকারিভাবে যেটুকু ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে, তা খুবই নগণ্য। ঢলের পানিতে সর্বস্ব ধুয়ে-মুছে যাওয়া এসব মানুষের দাবি নগণ্য ত্রাণ নয়, কর্মসংস্থানের। গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, তিস্তাপারের পূর্ব ছাতনাই ও ঝুনাগাছ চাঁপানী ইউনিয়নের সাড়ে ৩০০ বন্যাকবলিত পরিবারের মধ্যে সরকারি ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে ২০ কেজি করে মোট সাত টন চাল বিতরণ করা হয়। প্রতিটি পরিবারে গড়ে পাঁচজন সদস্য থাকলে মাথাপিছু চাল পেয়েছে চার কেজি করে। জেলা ত্রাণ অফিস সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত তিন হাজার ১৪২টি পরিবারকে ২০ কেজি করে মোট ৫৫ টন চাল এবং ১০০ পরিবারকে ৫০০ করে মোট ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। তবে সামান্য ত্রাণের চেয়ে বন্যাকবলিত এসব মানুষের এখন কাজই পরম চাওয়া। তাদেরই একজন পূর্ব ছাতনাই গ্রামের হজরত আলী (৭০)। তিনি বলেন, ‘ওই ২০ কেজি চাউল দিয়া মোর চার দিন চলিবে। এরপর কী করিম বাহে। তোমরা মোক একখান কামের (কাজ) ব্যবস্থা করি দেও।’ ডিমলা উপজেলার ঝাড়সিংহেশ্বর গ্রামের রবিউল মিয়া (৩০) বলেন, ‘হামেরা সরকারের কাছোত রিলিফ চাই না। একখান কাম চাই।’ রৌমারী (কুড়িগ্রাম) : গত দুই দিন কুড়িগ্রামের রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলার বন্যাকবলিত ব্রহ্মপুত্র নদ বিচ্ছিন্ন চরজনপদ ঘুরে দেখে গেছে দুর্গত এলাকায় রীতিমতো ‘লোকদেখানো’ সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম। আরো নিশ্চিত হওয়া গেল উপজেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী রৌমারী উপজেলায় বন্যা ও নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৬৫ হাজার। সেখানে ত্রাণ হিসেবে খয়রাতি (জিআর) চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৩০ টন, যা গত ৯ দিনে মাথাপিছু ৫০০ গ্রামেরও কম। একইভাবে রাজীবপুর উপজেলায় ৯৮ শতাংশ বন্যাদুর্গত এলাকা উল্লেখ করা হয়েছে। সে হিসেবে বন্যা ও নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত জনসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। গতকাল সোমবার পর্যন্ত যে পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে, তাতে ৯ দিনে মাথাপিছু এক কেজি করে ত্রাণ পেয়েছে দুর্গতরা। এর ফলে অনেক মানুষই এখনো ত্রাণের মুখ দেখেনি। তাদের একজন চায়না বেগম (৩২)। তিনি জানান, স্বামী হাফিজুর রহমান ঢাকায় রিকশা চালান। তাঁদের ঘরে তিন সন্তান। দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বন্যার পানি ঘরে ঢুকেছে ৯ দিন আগে। তিনি বলেন, ‘ঘরে যা চাইল ছিল, তা শ্যাষ হইছে তিন আগেই। দুই কেজি চাইল কর্জ করছি। কইছি, পোলার বাব আইলে দিয়া দিমু।’ শিবচর (মাদারীপুর) : শিবচর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে ত্রাণের অভাবে হাহাকার ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। শিবচরের চরজানাজাত ইউনিয়নের আট শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সরকার এখন পর্যন্ত এই নদীভাঙনের শিকার ৭০০ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দিয়েছে। তবে চরাঞ্চলের বন্দরখোলা, কাঁঠালবাড়ী ও মাদব চর ইউনিয়নের পানিবন্দি ৩০ হাজার মানুষ এক মুঠো চালও পায়নি। শেরপুর : শেরপুর জেলার বন্যাকবলিত মানুষ ফসল হারিয়ে দিশেহারা। কৃৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, জেলা সদর, শ্রীবরদী ও নকলা উপজেলায় ৬৫ হাজার রোপা আমনের মধ্যে বন্যায় আট হাজার ৩৭৭ হেক্টর জমির রোপা আমন পানিতে নিমজ্জিত। অন্যদিকে শেরপুর সদর উপজেলার বেতমারী-ঘুঘুরাকান্দি ইউনিয়নের মধ্য চরখারচর গ্রামে গতকাল বিকেলে বন্যার পানিতে ডুবে মেরিনা বেগম (৮) নামে আরো এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মেরিনা গ্রামের হানিফ মিয়ার মেয়ে। বগুড়া : যমুনার পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ১৭ সেন্টিমিটার কমলেও এর কোনো প্রভাব পড়েনি লোকালয়ে। সারিয়াকান্দি উপজেলার রৌহদহ গ্রামে প্রথম দিন ৩০০ মিটার বাঁধ ভেঙে পানি যমুনার পশ্চিম তীরের লোকালয়ে প্রবেশ শুরু করেছিল। এখন সেই ভাঙা স্থান প্রশস্ত হতে হতে দেড় কিলোমিটার এলাকায় ঠেকেছে। অন্যদিকে বগুড়ার ধুনটে বন্যার পানিতে ডুবে মাদ্রাসাছাত্রী ও গৃহকর্মী মারা গেছে। এর মধ্যে সাফি খাতুন (১২) উপজেলার কাদাই গ্রামের আব্দুল বাকীর মেয়ে ও কাদাই দাখিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী এবং মনিকা খাতুন (১৫) শিয়ালী গ্রামের দিনমুজর সাহেব আলী মেয়ে। ধুনটে ত্রাণের চাল লুট : বগুড়ার ধুনটে বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণের চাল বিতরণকালে আলতাব হোসেন (৪২) নামে এক ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যকে মারধর করে চাল লুট করেছে বানভাসি মানুষ। গতকাল দুপুরে ধুনট-জোড়শিমুল পাকা রাস্তার জামতলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আলতাব হোসেন চিকাশি ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য। আলতাব হোসেন অভিযোগ করেন, অতিরিক্ত চাল দিতে অস্বীকার করায় আব্দুর রশিদ নামের এক ব্যক্তি ও তাঁর লোকজন তাঁকে মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে তারা ছয় বস্তা চাল লুট করে নিয়ে যায়। তবে আব্দুর রশিদ বলেন, চাল বিতরণে অনিয়ম করায় তিনি ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলেন। পরে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলে তখন বানভাসি মানুষ হয়তো চালগুলো লুট করেছে। সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। গতকাল সকালে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ১৪ সেন্টিমিটার কমেছে। টাঙ্গাইল : বাসাইল উপজেলার ঝিনাই নদীতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। উপজেলার নথখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কিছু অংশ এরই মধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে টাঙ্গাইল-বাসাইল সড়কের নথখোলা ব্রিজ ও স্থানীয় শহীদ মিনার। চাঁদপুর মেঘনার চাঁদপুরের অংশে পানি এখন বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখে পড়েছে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের বড়স্টেশন পয়েন্ট। গত দুই দিনের ওই এলাকার বেশ কিছু সিসি ব্লক ভেসে গেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পানি উন্নয়ন বোর্ড ঢাকা থেকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একাধিক বিশেষজ্ঞ চাঁদপুরে পাঠিয়েছে। পিরোজপুর : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার বলেশ্বর নদ তীরবর্তী স্টিমারঘাট ও লঞ্চঘাট বাজার ভাঙনের কবল থেকে রক্ষার দাবিতে গতকাল সকালে নদীর তীরে ভুক্তভোগী এলাকাবাসী মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। তারা বড়মাছুয়া বাজার ও স্টিমারঘাট রক্ষার দাবি জানিয়ে ভাঙনকবলিত স্থানে ব্লক নির্মাণসহ ভাঙন প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায়। মানববন্ধন শেষে মাছুয়া লঞ্চঘাট মোড়ে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য দেন বড়মাছুয়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বিএসসি, মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম মোল্লা, ইউপি সদস্য মো. বাবুল আকন, ব্যবসায়ী কবীর মিয়া, যুবলীগ নেতা মাইনুল ইসলাম, জেলে মানিক খন্দকার, ফারুক তালুকদার প্রমুখ। রাজবাড়ী : পদ্মার পানি কমতে থাকায় রাজবাড়ীতে বন্যা পরিস্থির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। নদীর পানি গতকাল ২৪ ঘণ্টায় পাঁচ সেন্টিমিটার কমেছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত পানি বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কুড়িগ্রাম : জেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে। তবে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। জেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি গতকাল মাত্র এক সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ ছাড়া চিলমারী উপজেলার কিশামতবানু নালারপাড় গ্রামের ওবায়দুল হকের ছেলে নূর আলম (দেড় বছর) গতকাল বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে। হবিগঞ্জ : মাধবপুর উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে নূরজাহান (২) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকালে মাধবপুর পৌর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নূর আলম মিয়ার শিশুকন্যা নূরজাহান সকালে খেলতে গিয়ে বাড়ির পাশে বন্যার পানিতে ডুবে গিয়ে মারা যায়। শরীয়তপুর : জেলায় বন্যার পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পদ্মার পানি ১০ সেন্টিমিটার কমে গতকাল বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বন্যার পানি ঢুকে পড়ে এ পর্যন্ত ৮৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বন্ধ রয়েছে ২০টি। গাইবান্ধা : জেলার ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, করতোয়াসহ সব নদীর পানি কমছে। তবে ঘাঘট নদের পানি গতকালও বিপৎসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। মুন্সীগঞ্জ : জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ১০০ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। তলিয়ে গেছে আগাম ফসলি জমি ও বীজতলা। বন্যাদুর্গত এলাকায় নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় জেলায় ৬৭টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে।
No comments:
Post a Comment