বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর চার দশকে অনেক দূর এগিয়েছে। আরো সামনে এগোনোর সুযোগ ছিল, এখনো আছে। তবে সুযোগ কাজে লাগাতে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও কিছু জাতীয় বিষয়ে ঐকমত্য। বাংলাদেশ প্রতিদিন আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে রাজনীতিবিদ, সুধীসমাজের প্রতিনিধি ও ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেছেন। তাঁরা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা, অর্থনীতির গতি ধরে রাখা, রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ করা- এস
ব বিষয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য থাকা দরকার। রাজনৈতিক সমস্যা মোকাবিলায় দলগুলোর মধ্যে সংলাপের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তাঁরা বলেন, মৌলিক বিষয়ে মতানৈক্য তৈরি করতে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকার-বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ হতে হবে। গতকাল শনিবার রাজধানীর বারিধারায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের কনফারেন্স হলে ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন। পত্রিকাটির সম্পাদক নঈম নিজামের সঞ্চালনায় ওই বৈঠকে রাজনীতিবিদদের মধ্যে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, সাবেক মন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম, ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ও সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মওলা রনি বক্তব্য দেন। সুধীসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার, মেজর জেনারেল (অব.) এম এ রশীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. অহিদুজ্জামান চান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা। ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ, সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, সহসভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন, বিজিএমইএর সহসভাপতি মো. শহিদুল্লাহ আজিম, উইমেন এন্টারপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ওয়েব) সভাপতি নাসরিন ফাতিমা আউয়াল মিন্টু ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক খুজিস্তা নূর ই নাহরিন মুন্নী উপস্থিত ছিলেন। গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান। অনুষ্ঠানটির মিডিয়া পার্টনার ছিল বেসরকারি টেলিভিশন একাত্তর টিভি ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। কখনো গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারিনি। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করতে হবে। গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে সভা-সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে করতে হবে। স্বাধীনতার মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। ১৫ আগস্ট বিতর্কিত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। রাজনীতিতে ২১ আগস্টের ঘটনায় জজ মিয়ার নাটক আর তৈরি করা যাবে না।’ বিগত সংসদ নির্বাচন বৈধভাবেই হয়েছে উল্লেখ করে প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ বলেন, নির্বাচন আরো প্রতিযোগিতামূলক হলে ভালো হতো। তিনি বলেন, ‘বিরোধী দলেরও অনেকটা বোধোদয় হয়েছে। তারা হরতাল ও সহিংসতার পথে নেই। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরোধী দলেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনীতিতে হরতাল, সভা-সমাবেশ সবই হবে। তবে সহিংসতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’ চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ বলেন, ‘রাজনীতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য। বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও পরিবর্তন করতে হবে। একটি নির্বাচন হলেই স্থিতিশীল গণতন্ত্র কিংবা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না। সব ক্ষেত্রে রুল অব ল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন কিংবা অর্থনীতিতে গতি আনতে হলে ভালো মানুষের প্রয়োজন। সেই দিকটাও আমাদের লক্ষ রাখতে হবে। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আরো এগিয়ে নিতে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে জাতীয় বিষয়ে সংলাপ-সমঝোতা। দেশকে এগিয়ে নিতে এর কোনো বিকল্প নেই।’ এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী। আমাদের দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু জ্বালাও-পোড়াও দিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা হবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে না। তাই বলছি, আপনারা রাজনীতিবিদরা সমঝোতা করুন।’ সঞ্চালনার ফাঁকে নঈম নিজাম বলেন, ‘একটি দেশ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া কোনোভাবেই অগ্রসর হতে পারে না। আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গণতন্ত্র ও আইনের শাসন খুবই জরুরি। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হতে হবে। ব্যবসায়ীসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। আমরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে চাই। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে চাই। আশাবাদী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দল-মত-নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করলে দেশের উন্নয়ন হবেই।’ অপ্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বাধা বলে উল্লেখ করেন কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম। তিনি বলেন, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র ও সরকার থাকা প্রয়োজন। এখন ক্ষমতায় যাওয়া ও প্রতিহিংসার রাজনীতি চলছে। দেশপ্রেমের রাজনীতি নেই, যা থাকা খুবই জরুরি। সাবেক ছাত্রনেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, এই নির্বাচন আইনগতভাবে বৈধ হলেও নৈতিকভাবে ঠিক ছিল না। বাংলাদেশের অবস্থান এখন স্বামী-সন্তানহারা বিধবা মহিলার মতো। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা না বললেও চালাকি করেছে। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এর সঙ্গে দরকার অবকাঠামো ও সুশাসন। নব্বইয়ের দশকের পর ব্যক্তি খাত ও বেসরকারি খাত চালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ফলে বিশ্বের ১১টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশও আছে। এ দেশের বঙ্গোপসাগর ঘিরে এরই মধ্যে অর্থনৈতিক মোর্চা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪৩ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। গার্মেন্ট সেক্টর, নারীর ক্ষমতায়নে আমরা ভালো করেছি। কিন্তু যেভাবে মানুষ তৈরি করার কথা ছিল তা হয়নি।’ এ ক্ষেত্রে তিনি চীনের উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘চীন জনশক্তিকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমাদের বিপুল জনশক্তিকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। রাজনৈতিক নেতাদের এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। ভালো মানুষ তৈরি করতে পারলে সন্ত্রাস, অনাচার, লুটপাট স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে।’ মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে সমঝোতা জরুরি। তবে সমঝোতা কাদের সঙ্গে হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর আজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে। দেশ এগোবে কিভাবে? জামায়াত, শিবিরসহ উগ্রবাদীরাও এ দেশে রাজনীতি করে। বিএনপির সঙ্গে তারা জোটবদ্ধ। এখন বিএনপির এই জোটের সঙ্গে সমঝোতার রাজনীতি কিভাবে হবে? আগে এই মীমাংসা করতে হবে। মেজর জেনারেল (অব.) এম এ রশীদ বলেন, ‘বাংলাদেশের স্থিতিশীল রাজনীতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাংবিধানিক কাঠামোয় আমাদের সবাইকে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিভাজিত রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। সহিংস রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ বেশির ভাগই ব্যবসায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক এ সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি। রাজনীতিবিদদের হাতেই রাজনীতি থাকতে হবে। বিজিএমইএর সহসভাপতি মো. শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘দেশের প্রধান সমস্যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এটা দূর করতে পয়সা খরচ করতে হবে না। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে আমাদের ক্রেতারা চলে যাচ্ছে। পোশাক পণ্য রপ্তানিতে আমরা এখন দ্বিতীয়। তবে প্রথম হতে চাই।’ স্বাগত বক্তব্যে পীর হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আজ দেশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পেশাদার সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকরা দুই রাজনৈতিক শক্তির দাসে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতি কোথায় যাওয়ার কথা ছিল! সিঙ্গাপুর আজ কোথায় চলে গেছে! এখন যদি বলা হয়, আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র তা কি এই জাতি শুনবে? এই জাতি গণতন্ত্র শিখেছে জন্মের পরপর। এই জাতি মুক্ত বিহঙ্গের মতো কথা বলতে শিখেছে জন্মের পরপর। কিন্তু আজ আমরা বাংলাদেশে শুনি ট্রেন দুর্ঘটনা, লঞ্চ দুর্ঘটনা, চারদিকে রাজনীতিতে লাশের মিছিল। গুম-খুনের মিছিল। মানুষের মৃত্যুর চাইতে আর কিছু বেদনাদায়ক হতে পারে না।
No comments:
Post a Comment