ফি বছর সেই একই রব। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম কমে গেছে, এবার দাম নির্ধারণ করা হবে না- তিন বছর ধরে কোরবানির ঈদের আগে এমন কথাই বলছেন ট্যানারি মালিকরা। ফড়িয়া ও আড়ত মালিকদেরও আগে থেকেই কম দামে চামড়া কিনতে বলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে যাওয়ার কথা বলে চামড়ার দাম বরাবরের মতোই কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমন প্রচারের সুফলও পাচ্ছেন ট্যানারি মালিকরা। এবার ঈদের এক মাস আগেই চামড়ার দাম কমে গেছে। আ
ড়াই হাজার টাকা দামের চামড়া এখন মাংস ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন দেড় হাজার টাকা দরে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চামড়া রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে প্রায় ৫১ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৬.৪৭ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতেও রমরমা অবস্থা। আগের বছরের তুলনায় ৪৮.৫৫ শতাংশ বেড়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে প্রায় ২৪ কোটি ডলার। পুরো বছর এমন রমরমা অবস্থার পর যখন কোরবানি ঘনিয়ে এলো তখন ট্যানারি মালিকরা বিশ্ববাজারে দাম কমে যাওয়ার কথা বলছেন। গত দুই বছর তাঁরা যা বলেছেন, এ বছরও একই কথা বলছেন। অবশ্য বিভিন্ন পণ্যের দাম সরবরাহকারী সংস্থা ইনডেক্সমুডির তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে বিশ্ববাজারে চামড়ার দর বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আর গত বছরের আগস্ট মাসের তুলনায় গত আগস্টে তা প্রায় ১৬.৬১ শতাংশ বেশি ছিল। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, গত বছর কোরবানিতে ৮০ লাখ পশু জবাই হয়েছে, যার বেশির ভাগ গরু। প্রতি চামড়ায় ৩০০ টাকা করে দাম কম দিলে গরিবরা (কোরবানির চামড়ার অর্থ যাদের দেওয়া হয়) কম পায় ২৪০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চামড়ার দাম কমিয়ে রাখতে প্রতিবছরই ট্যানারি মালিক, আড়তদার ও মজুদদাররা একজোট হন। কোরবানি এলে তাঁরা চামড়ার দাম কমে গেছে বলে হুজুগ তোলেন। আবার ব্যবসায়ীদের পাওনা আটকে দিয়ে নগদ টাকার সংকট তৈরি করেন। এতে চামড়ার দাম কমে যায়।’ দুই মাস আগে যে চামড়ার দাম সাড়ে চার হাজার টাকা ছিল, সেটি এখন দুই হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কোরবানিতে লোকসান হবে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীর, ঠকবে গরিব মানুষ। আর যারা চামড়া লবণ দিয়ে মজুদ রাখতে পারবে তারা কিছুটা লাভ করতে পারবে।’ আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম প্রতি মাসেই সামান্য পরিমাণে ওঠানামা করে। তবে মোটা দাগে গত পাঁচ বছরে চামড়ার দাম মোটেও কমেনি, বরং তা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে প্রতি পাউন্ড চামড়ার দর ছিল ৫৭ দশমিক ৮৫ সেন্ট। গত এক বছরের হিসাব বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, গত বছরের আগস্ট মাসে প্রতি পাউন্ড চামড়ার দাম ছিল ৯৫ দশমিক ৩৩ সেন্ট। গত আগস্ট মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১১ দশমিক ১৭ সেন্ট। অথচ তিন বছর ধরে ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে দর কমে যাওয়ার কথা বলছেন। সেই তিন বছরকে বিবেচনায় নিলেও দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে দাম প্রায় ২৯ শতাংশ বেড়েছে। আগামী মঙ্গলবার চামড়ার দাম নির্ধারণ নিয়ে একটি বৈঠক করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এবার দাম নির্ধারণ করা হবে কি না জানতে চাইলে গত শুক্রবার বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা দাম নির্ধারণের পক্ষপাতী না। দেখা যাক মঙ্গলবারের বৈঠকে কী হয়।’ তিনি দাবি করেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হওয়ায় চামড়ার চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে। তাঁদের কাছে এখন ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার চামড়া মজুদ আছে। অবশ্য কালের কণ্ঠ ও অন্য পত্রিকা ঘেঁটে দেখা যায়, তিন বছর ধরে তাঁরা একই কথা বলছেন। ২০১২ ও ২০১৩ সালে তাঁরা আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দা, রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়ে যাওয়া ও চামড়া মজুদ থাকার কথা বলেছেন। বিশ্ববাজারে কম দামের কথা বললেও সেই চামড়া আবার হাতছাড়া করতে নারাজ ট্যানারি মালিকরা। প্রতিবছর তাঁরা চামড়া কেনার জন্য বাড়তি ঋণ দাবি করেন। চামড়া ভারতে পাচার ঠেকাতে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের দাবিও তোলেন তাঁরা। ২০১২ সালে ট্যানারি মালিকরা বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছিলেন। ২০১৩ সালে তাঁরা বিশ্ববাজারে দাম কমে যাওয়ার রব তুললেও চামড়া কেনার জন্য তাঁরা ১০০ কোটি বাড়িয়ে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এ বছর ব্যাংকগুলো বলছে, তারা ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দেবে। শাহীন আহমেদ জানান, ব্যাংকগুলো এবারও ৪০০ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। তিনি দাবি করেন, ব্যাংকগুলো মূলত পুরনো ঋণ নবায়ন করে দিচ্ছে। বিশ্ববাজারে চামড়ার চাহিদা আরো বাড়ছে বলে বলা হয়েছে ব্রিটেনভিত্তিক পোশাক ও বস্ত্র খাতের ওয়েবসাইট ‘জাস্ট স্টাইল ডটকম’-এর একটি প্রতিবেদনে। গত মার্চে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশগুলোতে গবাদি পশুর উৎপাদন সেভাবে বাড়ছে না। অন্য ফসল চাষের জন্য সেখানে গবাদি পশু উৎপাদনে পর্যাপ্ত জমি পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু পাদুকাশিল্পে চামড়ার চাহিদা বাড়ছে। এ শিল্পে মোট চামড়ার ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে নতুন প্রতিযোগী হয়ে উঠছে মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্যের কভার হিসেবে চামড়াজাত পণ্যের ব্যবহার। মোট চামড়ার ১২ শতাংশ এখন ব্যবহার করছে তারা। অন্যদিকে গ্লাভস, ওয়ালেটস, পারস, পোশাক ইত্যাদি তৈরিতে চামড়ার চাহিদা বাড়ছে। মোট চামড়ার ৩৮ শতাংশ ব্যবহৃত হয় এ খাতে।
No comments:
Post a Comment