বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) আইনে পরিবর্তন, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ও জাতীয় সংসদের হাতে বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা দেয়ায় দেশের সুশীলসমাজের মধ্যে ক্ষোভ ও হাতাশা সৃষ্টি হয়েছে। উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সরকার আইন ও নীতিমালা সংশোধন ও পরিমার্জন করছে বলে মনে করে সুশীলসমাজ। এভাবে চলতে থাকলে দেশ দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কটে পড়বে। গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো ভেঙে পড়ারও আশঙ্কা করছেন সুশীলসমাজ
ের প্রতিনিধিরা। এসব আইন ও নীতিমালার ফলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করার স্বাধীনতা হারাবে বলে মনে করেন তারা। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, এনজিও আইনে সংযোজন ও সংশোধন, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা করা ও বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়াÑ এই তিনটি আইন ও নীতিমালা একই সূত্রে গাঁথা। এই আইন ও নীতিমালা চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন হলে বেসরকারি সংস্থাগুলো ও বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার খর্ব হবে। উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশে যে ধরনের রাজনীতির চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তাতে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে গেলে বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ হবে। বলা যায়, সরকার সার্বিকভাবে সরকারি-বেসরকারি কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে একপ্রকার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। প্রধান বিরোধী দল সংসদে অনুপস্থিত থাকায় সরকার এ সুযোগটা নিতে পারছে। এই নীতিমালা ও আইন বাস্তবায়ন হলে সরকারের জবাবদিহিতার ক্ষেত্র সঙ্কোচিত হবে। সরকারের ওপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হবে। দীর্ঘ মেয়াদে একটি সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, জনগণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে আলাপ না করে সরকার এককভাবে এই আইন ও নীতিমালার অনুমোদন দেয়ায় তা হবে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিপন্থী। তিনি বলেন, প্রায় দুই বছর আগে সংশ্লিষ্টদের সাথে পরামর্শ করলেও কাটছাঁট করে সরকার নিজেদের মতো করে এনজিও আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে। বেসরকারি সংস্থা পরিচালনার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কখনোই কাম্য নয়। তবে চূড়ান্ত খসড়াটি আইনমন্ত্রী সম্প্রতি পুনর্বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন। শিগগিরই এর বাস্তবায়ন হবে, এটা প্রত্যাশা রাখি। এভাবে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ও বিচারপতিদের অপসারণ আইনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করলে দেশ ও জাতির জন্য তা মঙ্গলজনক হবে। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না নয়া দিগন্তকে বলেন, এই নীতিমালা ও আইন করা সরকারের জন্য অবশ্যই দরকার ছিল। গত ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের আগে সরকার বলেছিল এটা একটি নিয়মরক্ষার নির্বাচন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এ নির্বাচন করা হচ্ছে। শিগগিরই আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। আর এখন বলছে, তারা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে। তিনি বলেন, সরকার যে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা করেছে তা অর্থহীন। নীতিমালায় বলা হচ্ছে, ভুল-ভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া যাবে না। যা বলব একেবারেই সত্য বলতে হবে। প্রকৃতপক্ষে সরকার বলার ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়। মুক্তভাবে সম্প্রচারের মাধ্যমে সরকারের ক্ষতি হচ্ছে। সরকারের কীর্তিকলাপ জনগণ জেনে যাচ্ছে। বিচারপতিদের অপসারণ আইন সম্পর্কে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক বলেন, এটি বাস্তবায়ন হলে বিচারব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে বিচার করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে উঠবে। জনগণের সমর্থন সরকারের ওপর না থাকায় চলছে কিছু বাহিনী দিয়ে। এই নীতিমালা ও আইনের মাধ্যমে যদি সরকার বিচারব্যবস্থা ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না। সরকারের কোনো জবাবদিহিতা থাকল না। ক্ষমতায় টিকে থাকা আরো সহজ হলো। এ সম্পর্কে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই আইনগুলো তৈরি করছে। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ও বিচারপতিদের অভিশংসন আইন করে সরকার ক্ষমতাকে সংহত করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা যদি না থাকে, যেমন আদালত যদি নারায়ণগঞ্জের মতো সাত খুনের বিচারকার্যক্রম স্বাধীনভাবে না করতে পারে সে ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বলয় সঙ্কুচিত হবে। সব ক্ষেত্রে সরকারের একক আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা থেকেই এই আইনগুলো তৈরি করা হচ্ছে। যেসব এনজিও সরকারের বিপক্ষে কথা বলছে তাদের ওপর পুলিশ-র্যাব দিয়ে খবরদারি করছে। এগুলো হচ্ছে মূলত ভিন্ন মতকে সরকার পুরোপুরি সহ্য না করার মানসিকতা থেকে। সরকার এমন একটা পর্যায়ে গেছে যে ভিন্ন মত থাকুক সরকার এটা চায় না। ড. পিয়াস করিম বলেন, সরকারের এ রকম কর্মকাণ্ডের ফলে দেশে গণতন্ত্র বাকরুদ্ধ হয় পড়ছে, কণ্ঠগুলো চেপে রাখা হচ্ছে। সরকারের এসব কার্যকলাপ অদূর ভবিষ্যতে জঙ্গিবাদকে উসকে দিবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমান সরকারের জন্য এই আইন ও নীতিমালা করা অবশ্যই দরকার ছিল। কারণ বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছে তারা নির্বাচিত নয়। তাই অবৈধ সরকার জনগণ ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর দমননীতি ও কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা চালাবে, এটাই স্বাভাবিক। ফলে আইন সংশোধন করে হোক আর নীতিমালা তৈরি করে হোক টিকে থাকতে হলে এটা প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া ভিন্ন মত যাতে সরকারের সমালোচনা না করতে পারে সে দিকেও নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা চালাচ্ছে। ড. আসিফ নজরুল আরো বলেন, এভাবে চলতে থাকলে দেশে গভীর সঙ্কট সৃষ্টি হবে। বিচারপতিরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। বিএনপিও ক্ষমতায় এলে একই ধরনের সমস্যা দেখা দেবে। তারাও চেষ্টা চালাবে এই আইন বা নীতিমালা ব্যবহার করে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দমন করতে। এটা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. নূহ উল আলম লেনিন বিশিষ্টজনদের এ বক্তব্য মানতে নারাজ। তার মতে, কিছু বুদ্ধিজীবী আছেন যারা সরকারের ভালো কাজ করলেও সমালোচনা করেন। সরকারের সব কাজের বিরোধিতা করা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান ফ্রি স্টাইলে চলতে পারে না। তাদের একটি নিয়মনীতির মধ্যে থাকতে হবে। সরকার যে আইন বা নীতিমালা করছে তা সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নয়। এই আইন বা নীতিমালা করার ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো আরো সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হবে। মূলত সংবিধানকে সুসংহত করতে ও গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করতে সরকারের এই উদ্যোগ। ড. লেনিন আরো বলেন, সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন যে বিরোধিতা করছেন তার রচিত সেই ’৭২-এর সংবিধানে তো এই আইন ছিল। ওই সময় তিনি কেন এই আইনটি করেছিলেন। এখন বিরোধিতা করছেন কোন অধিকারে?
No comments:
Post a Comment