পাঁচ বছর আগে শিশু মাইমুনা আক্তারের (৬) মা মারা যান। পরে বাবা বিয়ে করলে সৎমায়ের কুনজর থেকে বাঁচাতে তাকে ছায়া দিয়ে রাখতেন দাদি ফুলমতি। রাতে ঘুমাত সে দাদির কাছেই। এক সপ্তাহ আগেও মাইমুনাকে বাথরুমে আটকে ড্রামের ভেতরে উল্টো করে চেপে ধরেছিল সৎমা। দেড় মাস আগে সৎমা শারমিন অবুঝ শিশুটিকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধরেছিল। দুবারই দাদি ফুলমতি তাকে রক্ষা করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ করেই মাইমুনাকে
নিজের বিছানায় ঘুম পাড়ায় সৎমা। আর গতকাল শুক্রবার সকালে বাথরুমের ড্রামের ভেতর পাওয়া গেল তার লাশ। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ধলপুর এলাকায় এ নির্মম হত্যাকাণ্ডটি ঘটে। এ ঘটনায় মাইমুনার সৎমা সুমাইয়া ইসলাম শারমিনকে (৩০) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে মাইমুনাকে হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে শারমিন। নিহত মাইমুনা স্থানীয় হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) মহিলা মাদ্রাসায় শিশু শ্রেণিতে পড়ত। অভিযুক্ত শারমিনের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারীতে। মাইমুনার বাবা আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা ওয়াসার যাত্রাবাড়ী অঞ্চল কার্যালয়ের স্টোরকিপার। মাইমুনা আক্তার স্বজন ও পুলিশের ধারণা, বৃহস্পতিবার রাতে প্রতিহিংসার কারণে শিশুটিকে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে সৎমা। মাইমুনার বাঁ হাত ভাঙা এবং বাঁ পায়ে কামড়ের দাগ দেখা গেছে। এ ব্যাপারে শিশুটির বাবা বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেছেন। গতকাল রাত পর্যন্ত দাদি ও সৎমাকে ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল পুলিশ। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি অবনী শংকর কর কালের কণ্ঠকে জানান, ধলপুর সূতীখাল পাড়ের হাসনাহেনা লোনের ৯৪/১১ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাটের বাথরুম থেকে গতকাল মাইমুনার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধারের সময় শিশুটির মাথা ছিল ড্রামের ভেতরে। আর পা দুটি ছিল বাইরে। বাঁ পায়ে কামড়ের মতো চিহ্ন ছিল। লাশের সুরতহালে বলা হয়েছে, মাইমুনার হাতের কবজি ভাঙা পাওয়া গেছে। ওসি আরো জানান, অন্য সময় মাইমুনা তার দাদির সঙ্গে ঘুমাত। তবে বৃহস্পতিবার বাথরুমের সামনের ফ্লোরে নাতনির পরনের প্যান্ট পড়ে থাকতে দেখে মাইমুনাকে ডাকাডাকি করেন দাদি ফুলমতি। কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি বাথরুমের দরজা খুলে ড্রামের ভেতর নাতনির লাশ দেখে চিৎকার দেন। তাঁর চিৎকারে প্রতিবেশীরা থানায় খবর দিলে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। ওসি বলেন, ‘রাতের কোনো একসময় হত্যাকাণ্ডটি ঘটে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সৎমা শারমিন হত্যার কথা স্বীকার না করলেও তার বিছানায় শিশুটিকে হঠাৎ করে ঘুম পাড়ানো নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। শিশুটি একা গিয়ে গিয়ে ড্রামে পড়ে গেলেও বাথরুমের কাছে তার সৎমা চিৎকার বা শব্দ পাওয়ার কথা ছিল। এ ছাড়া মাইমুনার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।’ নিহত মাইমুনার বাবা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বৃহস্পতিবার তিনি মাদারীপুরের বিশালকোটি থানার রাজুতে গ্রামের বাড়ি যান। শুক্রবার বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরার পথে মাইমুনা হত্যার খবর পান। মাইমুনাকে স্ত্রী হত্যা করেছে কি না, জানতে চাইলে রাজ্জাক বলেন, ‘এটি আমি জানি না। তবে যে-ই হত্যা করুক না কেন, আমি তার যথাযথ বিচার চাই।’ সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, ধলপুর খালেকুজ্জামান গলির ৯৪/১১ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলায় আব্দুর রাজ্জাক তাঁর মা ফুলমতি (৮৭), দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন ও শারমিনের দুই কন্যাসন্তান মাইশা ইসলাম লামিয়া (২), দেড় মাস বয়সী মারিয়া ইসলাম কিপতিয়া এবং প্রথম স্ত্রীর সন্তান মাইমুনাকে নিয়ে বসবাস করতেন। মাইমুনার দাদি ফুলমতি বলেন, সৎমা শারমিন প্রায়ই মাইমুনাকে মারধর করত। গত সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় মাইমুনাকে বাথরুমে আটকে ড্রামের ভেতরে উল্টো করে চেপে ধরেছিল শারমিন। পরে ফুলমতি তাকে রক্ষা করেন। এক-দেড় মাস আগেও শারমিন অবুঝ শিশুটিকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধরেছিল। ফুলমতি আরো বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে শারমিন একা ঘুমাতে ভয় পায়- এ কথা বলে মাইমুনাকে তার কাছে নিয়ে যায়। মাইমুনার চাচাতো ভাই মোহাম্মদ আউয়াল বলেন, পাঁচ বছর আগে মাইমুনার মা রুনা মারা যান। এর কিছুদিন পরই আব্দুর রাজ্জাক শারমিনকে বিয়ে করেন। আউয়াল অভিযোগ করেন, ‘আমরা আত্মীয়স্বজনরা বাসায় বেড়াতে এলেই দেখতাম চাচি (শারমিন) মাইমুনাকে কারণে-অকারণেই মারধর করত।’
No comments:
Post a Comment