রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদ হার কমাতে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন এমডিরা। একই সঙ্গে সব ক্ষেত্রেই অভিন্ন সুদ হার নির্ধারণেও সিদ্ধান্ত হয়েছে। উচ্চ সুদে ঋণ বিতরণ কমে যাওয়ায় ব্যাংক মুনাফায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে সুদ নিয়ে ব্যাংকগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে এ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এছাড়া নজরদারির আওতায় আসছে শাখা অফিসের কার্যক্রম। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের ঋণ পেতে ভোগান্তি ও গ্রাহক
দের সঙ্গে আচরণও প্রধান কার্যালয় নজরদারি করবে। পাশাপাশি এফডিআরের (ফিক্সড ডিপোজিট রেট) সর্বোচ্চ সুদ দশমিক ৫০ শতাংশ কমিয়ে ৯ শতাংশ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার মতিঝিলে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে সরকারি ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠক উপস্থিত ছিলেন এমন একটি সূত্র যুগান্তরকে এসব বিষয় নিশ্চিত করেন। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জিল্লুর রহমান। সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক, কৃষি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। তবে ড. জিল্লুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আমরা এমন পদক্ষেপ নিতে চাই যাতে ব্যাংক এবং ব্যবসায়ী উভয়ই লাভবান হয়। সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর মাত্রাতিরিক্ত সুদের কারণে বিনিয়োগ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। একদিকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, অপরদিকে নতুন ঋণ বিতরণ কমে এসেছে। ফলে ব্যাংক মুনাফায় বড় ধরনের প্রভাব পড়ার আশংকা করছিলেন ব্যাংকাররা। এরপর সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে নামাতে সরকারি ব্যাংকগুলোর এমডিদের এ বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে উল্লেখ করা হয়, সামগ্রিকভাবে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা চলছে। নতুন করে বিনিয়োগ হচ্ছে না। নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন, এ ধরনের ব্যবসায়ীরাও খেলাপি হচ্ছেন। আর অতিরিক্ত সুদের কারণে নতুন ঋণ বিতরণ একেবারে কমে আসছে। কিছু ব্যাংক যতটুকু ঋণ বিতরণ করতে পারবে, গ্রাহকের কাছ থেকে ওই পরিমাণ আমানত নিচ্ছে। ফলে ঋণের সুদ কমানোর ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমানত ও সুদের ব্যবধান সাড়ে ৩ শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে। আর তা সম্ভব না হলে কোনো অবস্থাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। বৈঠক সূত্র জানায়, সরকারি ব্যাংকগুলোও এখন ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নেয়। আর নতুন এই নিয়ম মানলে শিল্পখাতে সাড়ে ১২ থেকে ১৩ শতাংশের মধ্যে ঋণ দেয়া যাবে। তবে এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব ‘কস্ট অব ফান্ড’ বিবেচনা করে সামান্য কিছু কম-বেশি হতে পারে। পাশাপাশি বৈঠকে দীর্ঘমেয়াদি আমানতের বিপরীতে অভিন্ন সুদ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর এফডিআরের সুদ ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ। নতুন নিয়মে তা ৯ শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা করবে না। তার মতে, দীর্ঘদিন পর এমডিদের মধ্যে অত্যন্ত খোলামেলা আলোচনা হয়। দুটি ব্যাংকের এমডি শাখা অফিস পর্যায়ে ঋণ পেতে ব্যবসায়ীদের হয়রানির কথা তুলে ধরেন। ঋণ পাওয়ার আগেই ঋণের একটি অংশ খরচ হয়। ফলে সিদ্ধান্ত হয়, শাখা অফিসের কার্যক্রম হেড অফিস থেকে জোরালো নজরদারি করা হবে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়া এবং অগ্রীম নেয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা কমিয়ে আনা হবে। সূত্র আরও জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোর বিদেশী ব্যবসায় মন্দা নেমে এসেছে। ফলে বিদেশী ব্যবসা সম্প্রসারণে নিজেদের মতো করে উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে ড. জিল্লুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ঋণের সুদের ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংকগুলো বরাবরই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করে। আমরা স্প্রেড ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৮ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ পর্যন্ত রাখে। আমরা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে চাই। সিদ্ধান্ত হয়েছে, স্প্রেড ৫ শতাংশের বেশি রাখা যাবে না। ব্যাংকগুলোকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ‘কস্ট অব ফান্ড’ বিবেচনা করে ঋণের সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে হবে। তবে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ব্যাংকের বাঁচতে হবে। তার মতে, গ্রামগঞ্জে সরকারি ব্যাংকের শাখা ছড়িয়ে আছে। ফলে সারা দেশের মানুষ এখানে আমানত রাখে। কম সুদ দিলে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে সুদের হার বেঁধে না দিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
No comments:
Post a Comment