ফেসবুকে পরিচয়, দুই দিন পরেই সাক্ষাৎ। প্রথম দেখাতেই ভালোলাগা, এরপর মন দেওয়া-নেওয়া। পরের দিনগুলো কেটে যায় ঘোরের ভেতর, ভা
লোবাসার পালতোলা নৌকায় ভাসতে-ভাসতে। শেষে পরিবারের অমতে পালিয়ে বিয়ে। স্বপ্নের মায়াজালে বোনা সাজানো সংসারে পয়সার টানাটানি থাকলেও সুখের কমতি ছিল না। এরই মধ্যে আসে সুখবর, নতুন অতিথি আসছে সংসারে, তাও একসঙ্গে দুজন। ইতিমধ্যে সংসারেও খানিকটা সচ্ছলতা ফিরেছে। খুশিতে যখন দুজনের আত্মহারা হওয়ার সময়, ঠিক তখনই হানা দেয় সন্দেহবাতিকতা। স্ত্রীকে সন্দেহ করতে শুরু করে স্বামী, তার মনে হতে থাকে- স্ত্রীর সঙ্গে অন্য কারো সম্পর্ক আছে। সন্দেহ একসময় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, যার পরিণতিতে বিয়ের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় গত শনিবার প্রিয় সেই মানুষটির গলাতেই ছুরি চালিয়ে দেয় সে। এতেই ক্ষান্ত হয়নি স্বামীটি, সোমবার রাত পর্যন্ত মরদেহ বাসাতেই লুকিয়ে রাখে। বাসা বদলের নামে গতকাল মঙ্গলবার ভোরে অন্য মালামালের সঙ্গে স্ত্রীর মরদেহ তোশকে পেঁচিয়ে পিকআপে তোলা শুরু করেছিল। পরিকল্পনা ছিল, যাওয়ার সময় কোনো আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেবে। কিন্তু এর আগেই আশপাশের লোকজন বুঝে ফেলে, হাতেনাতে ধরে গণপিটুনি দিয়ে তাকে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশ ও সাংবাদিকদের কাছেও অকপটে সব কথা স্বীকার করেছে রফিকুল ইসলাম নীল (২৫) নামের ওই তরুণ। গাজীপুর সদরের দক্ষিণ ছায়াবীথি এলাকায় ঘটেছে এ ঘটনা। ওই গৃহবধূর নাম নাজমুন নাহার পাপিয়া (২২)। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গণিত বিভাগে সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন তিনি। তাঁর বাবা মো. গোলাম জিলানী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার। রাজশাহী সদরের বোয়ালিয়ায় পদ্মা আবাসিক এলাকায় ১৮১ মেহেরচণ্ডী পূর্বপাড়ায় তাঁর বাসা। পাপিয়ার গলা কাটা ছাড়াও তাঁর দুই পা কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল। ডান পা হাঁটুর ওপর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। জয়দেবপুর থানার পুলিশ গতকাল সকাল ৭টার দিকে মরদেহ উদ্ধার করে গাজীপুর সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। রফিকুল ইসলামের বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার সুকুন্দী গ্রামে। তার বাবার নাম হুমায়ুন কবির। রফিকুল পুরান ঢাকার পোস্তগোলা এলাকার একটি রিরোলিং মিলে চিফ মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে কর্মরত। গ্রেপ্তারের পর গতকাল রাত পর্যন্ত তাকে জয়দেবপুর থানা হাজতে রাখা হয়েছিল। রফিকুল ও পাপিয়া দক্ষিণ ছায়াবীথি এলাকায় অ্যাডভোকেট শামীম ভূঁইয়ার বাসার (১০৭/২ নম্বর) পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। গতকাল জয়দেবপুর থানার পুলিশ ও ছায়াবীথি এলাকার লোকজন জানায়, বাসা পরিবর্তনের জন্য সোমবার রাতে রফিকুল একটি পিকআপ ভাড়া করে নিয়ে আসে। আজ (মঙ্গলবার) ভোরে পিকআপে মালপত্র তোলা শুরু হয়। তোশক ওঠানোর সময় অস্বাভাবিক ভারী এবং তা থেকে দুর্গন্ধ বের হতে থাকলে পিকআপের হেলপার তানজিমের সন্দেহ হয়। তোশকের ভেতর কী আছে- জানতে চায় সে। প্রশ্ন শুনেই দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে রফিকুল। তানজিমও দৌড় দেয়। একসময় রফিকুলকে জাপটে ধরে চিৎকার শুরু করে সে। এতে আশপাশের লোকজন জড়ো হয়ে রফিকুলকে পিটুনি দেয়। এ সময় সে (রফিকুল) স্ত্রীকে জবাই করে খুন এবং বাসা বদলের নামে তোশকে মুড়িয়ে মরদেহ নিয়ে পালানোর কথা স্বীকার করে। থানায় আটক রফিকুল ইসলাম দাবি করে, ‘পাপিয়াকে ভালোবেসে তাকে খুশি করতে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম আর শরীরের ঘাম ঝরিয়েছি। সে যা চেয়েছে তা-ই কিনে দিয়েছি। চার-পাঁচ হাজার টাকার নিচে সে ড্রেস কিনত না। কেনা অনেক ড্রেস এখনো পরাই হয়নি। সেই স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িয়ে অন্য যুবকের প্রেমে মত্ত- এটা মেনে নিতে পারিনি। তাই সে যেন আর এসব করতে না পারে সে জন্য খুন করেছি।’ রফিকুল অকপটে বলে যেতে থাকে, ‘বিয়ের পর ওকে ছাড়া এক বেলাও খাইনি। সকাল ৬টায় বেরিয়ে রাত সাড়ে ১১টা-১২টায় বাসায় ফিরতাম। বাসায় ফিরে আমরা একসঙ্গে খেয়েছি। খুনের পর ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত পানি ছাড়া কিছুই খাইনি। ও ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। পেটে যমজ সন্তান ছিল। প্রতি সপ্তাহে আমি তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম। তার পরও ও কেন যে অন্যের প্রতি আসক্ত হলো, বহু চেষ্টা করেও সে কথা বের করতে পারিনি।’ একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে রফিকুল। বলে, ‘জানি, আমি বড় অপরাধ করেছি। আমাকে আদালতে পাঠান। আমি সব খুলে বলব। এতে যদি আমার ফাঁসি হয়, তাতেও দুঃখ নেই।’ খুনের বিষয়ে রফিকুল পুলিশের কাছে দাবি করেছে, গত শনিবার সকাল ৬টার দিকে সে প্রথমে পাপিয়ার গলা চেপে ধরে। শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়লে মুখে ওড়না ঢুকিয়ে দেয়, এরপর বাসায় সবজি কাটার জন্য রাখা ছুরি দিয়ে জবাই করে খুন করে। পরে লাশ খাটের নিচে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে লুকিয়ে রাখে। শনিবার সারা দিন বাসাতেই কাটিয়ে দেয় সে, রবিবার অফিসে যায়। ছুটির পর পোস্তগোলা এলাকায় সাত হাজার টাকায় একটি বাসা ভাড়া করে। সোমবার রাতে মালামাল নিয়ে নতুন বাসায় ওঠার পরিকল্পনা ছিল। পথে সুযোগ বুঝে তোশকের ভেতর রাখা লাশ ময়লাযুক্ত কোনো স্থানে ফেলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তোশকে মোড়ানোর পর যাতে মরদেহ না নড়ে সে জন্য সোমবার রাতে কাপড় দিয়ে দুই পা বেঁধে ফেলে রফিকুল। বাড়তি কাপড় ছুরি দিয়ে কাটতে গিয়ে চাপ লেগে পাপিয়ার ডান পা কেটে যায়। লাশ পচে নরম হয়ে গিয়েছিল। রফিকের ভাষ্য মতে, গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে মাস্টার্স শেষ বর্ষে পড়ার সময় গত বছর আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য রাজধানীর গুলশানের সিঙ্গাপুর পিলিং সাউথ পয়েন্ট স্কিলস সেন্টারে ভর্তি হয় সে। সেখানেই গত ২ মে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয় পাপিয়ার সঙ্গে। পাপিয়া রাজশাহী থেকে ঢাকায় বড় বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছিল। পরিচয়ের দুই দিন পর তারা একে অন্যের সঙ্গে দেখা করে। প্রথম দেখাতেই একে অন্যের প্রেমে পড়ে। পরে দুজনই পরিবারের অমতে গত ২৫ মে সাভার ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে। দুই পরিবারই বিয়ে মেনে নেয়নি। বাধ্য হয়ে মাসে ছয় হাজার টাকা ভাড়ায় ছায়াবীথি এলাকার ওই বাসায় ওঠে তারা। রফিক দাবি করে, ‘রি-রোলিং মিলে চাকরি পাওয়ার পরও সংসারে সচ্ছলতা আনতে দুটি টিউশনি শুরু করি। সকাল ৬টায় বেরিয়ে বাসায় ফিরতাম রাত ১১টার পর। স্ত্রীর মোবাইলে ফোন করলে নম্বর ব্যস্ত পেতাম। কখনো বাসায় ফিরে দেখতাম আলনায় নতুন শার্ট। জিজ্ঞেস করলে পাপিয়া বলত, আমার জন্য কিনে এনেছে। কিন্তু নতুন শার্টে ঘামের গন্ধ পাওয়া যেত। পরে জেনেছি অফিসে গেলে ঢাকার উত্তরা এলাকার একটি ছেলে বাসায় আসে। তার সঙ্গে পাপিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে কথা বলে। এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছি, সঠিক জবাব না দিয়ে ও এড়িয়ে যেত। এ নিয়ে মারাত্মক হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না।’ বাসার মালিক অ্যাডভোকেট শামীম ভুঁইয়া বলেন, ‘রফিকুল নিয়মিত ভাড়া দিত। দুই দিন আগে সে জানায়, যাতায়াত সমস্যার কারণে সে ঢাকায় বাসা নিয়েছে, তাই বাসা ছেড়ে দিচ্ছে। সোমবার রাতে মালপত্র নিয়ে যেতে চাইলে পরদিন সকালে যেতে বলি। সে স্ত্রী খুন করে বাসা বদলের নামে লাশ নিয়ে পালাচ্ছিল, তা জানা ছিল না।’ পিকআপের হেলপার তানজিল হোসেন বলে, ‘পোস্তগোলা যাওয়ার কথা বলে সোমবার রাতে দুই হাজার ৭০০ টাকায় রফিকুল পিকআপটি ভাড়া করে। ভোর ৫টার দিকে মালপত্র পিকআপে তোলা শুরু করি। তোশক ওঠাতে গিয়ে খুব ভারী মনে হয়, দুর্গন্ধও বের হচ্ছিল। ভেতরে কী আছে জানতে চাইলে রফিকুল দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। সন্দেহ হলে আমিও দৌড়ে গিয়ে তাকে জাপটে ধরি। পড়ে এলাকার লোকজন ধরে পিটুনি দিলে সে সব খুলে বলে।’ পুলিশের কাছ থেকে খবর পেয়ে গতকাল সন্ধ্যায় পাপিয়ার মা-বাবা, দুই ভাই ও এক মামা গাজীপুরে পৌঁছেন। পাপিয়ার মামা মো. মহিউদ্দিন বাদী হয়ে এ ব্যাপারে জয়দেবপুর থানায় হত্যা মামলা করেছেন। গাজীপুর সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। উত্তরা ও সাভারের আশুলিয়ায় পাপিয়ার মামার বাড়ি আছে। স্বজনরা জানায়, আশুলিয়াতেই তার মরদেহ দাফন করা হবে। গাজীপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. আবদুস সালাম জানান, জবাইয়ের আগে শ্বাসরোধের আলামত পাওয়া গেছে। পাপিয়ার গর্ভে যমজ সন্তান ছিল। তবে গতকাল রফিকুলের পরিবারের কেউ থানায় কিংবা পাপিয়ার স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। জয়দেবপুর থানার এসআই আরশাদ হোসেন মামলার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, ওই বাসায় তল্লাশি চালিয়ে আলামত হিসেবে একটি ছুরি জব্দ করা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment