চার মাসেরও আগে গত ২৪ জুন একবার রায়ের দিন ধার্য হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেদিন
তাঁর মামলার রায় ঘোষিত হয়নি। আজ বুধবার আবার সেই রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য হয়েছে। মতিউর রহমান নিজামীকে আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির রাখতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত রাতেই নিজামীকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়েছে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল মঙ্গলবার নিজামীর মামলার রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিন ধার্য করে আদেশ দেন। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহযোগী আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায়ের অপেক্ষা শেষ হতে চলেছে। নিজামীর রায় ঘোষণার পর দুটি ট্রাইব্যুনালে আরো পাঁচটি মামলা রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ থাকবে। একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখার ১১ মাস ১৫ দিন পর অপেক্ষার পালা ফুরাচ্ছে আজ। গত বছর ১৩ নভেম্বর এ মামলা রায় ঘোষণার জন্য প্রথমবারের মতো অপেক্ষমাণ রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। আসামিপক্ষকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সুযোগ দেওয়া, ১ নম্বর ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবিরের অবসরে যাওয়া, ওই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীমকে চেয়ারম্যান করা, নতুন করে যুক্তিতর্ক শোনা এবং সর্বশেষ নিজামী অসুস্থ হয়ে পড়ায় মামলাটির রায় ঘোষণায় বিলম্ব ঘটেছে। গতকাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর দৈনন্দিন কার্যতালিকায় ১ নম্বরে নিজামীর মামলা ছিল। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি, প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল এবং নিজামীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হন। এরপর ট্রাইব্যুনাল নিজামীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করেন। এদিকে রাষ্ট্রপক্ষ প্রত্যাশা করছে নিজামীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হবে। এ বিষয়ে প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা নিজামীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করছি। বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য তৈরি করা আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন নিজামী। তাই তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি ছাড়া বিকল্প নেই। অন্যদিকে নিজামীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি বলে দাবি করেছেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। নিজামীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, মাওলানা নিজামী জামায়াতের আমির না হলে তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হতো না। তিনি বলেন, প্রসিকিউশন নিজামী সাহেবের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ আনেননি। এ অভিযোগ বেলজিয়াম থেকে আহমেদ জিয়াউদ্দিন পাঠিয়েছেন। সে সময়কার ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক স্কাইপ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে এ অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেন, নিজামী সাহেব ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ছাত্রসংঘের দায়িত্বে ছিলেন। অথচ বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা ঘটেছে ডিসেম্বরে। তাই বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য নিজামী সাহেব দায়ী হতে পারেন না। সুতরাং নিজামী সাহেবের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা। গত ২৪ জুন নিজামীর রায়ের জন্য দিন ধার্য ছিল। এ জন্য সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু নিজামীর অসুস্থতার খবরসংবলিত স্বাস্থ্য প্রতিবেদন নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন এলে রায় ঘোষণা না করে আবারও অপেক্ষমাণ রাখার আদেশ দেওয়া হয়। সেদিনের আদেশে বলা হয়, ‘আমরা আসামির অনুপস্থিতিতে রায় ঘোষণা যুক্তিসংগত মনে করছি না। আমরা সিএভি (রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ) রাখছি। একই সঙ্গে তাঁর স্বাস্থ্যের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল প্রতিবেদন চাওয়া হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব এ প্রতিবেদন দিতে হবে। এই প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী আদেশ দেওয়া হবে।’ এ ঘটনার দুই দিন পর ২৬ জুন কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীর স্বাস্থ্যসংক্রান্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজামীর শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে। এর কয়েক দিন পর ৩ জুলাই কারা কর্তৃপক্ষ আরো একটি প্রতিবেদন দেয়। তাতে নিজামীকে সুস্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং তাঁকে ওই দিন সকালে কারা হাসপাতাল থেকে কারাগারের নিজ কক্ষে (সেলে) পাঠানোর তথ্য জানানো হয়। এ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার প্রায় চার মাস পর রায় ঘোষণা হতে চলেছে। এর মধ্য দিয়ে একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে নিজামীর মামলার রায় হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দশম রায়। এর আগে ১০ জনের বিরুদ্ধে ৯টি মামলায় রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এসবের মধ্যে ১ নম্বর ট্রাইব্যুনাল থেকে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলায় রায় হয়েছে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান হওয়ার পর এটাই হবে তাঁর প্রথম রায়। ২ নম্বর ট্রাইব্যুনাল থেকে রায় দেওয়া হয় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লা, বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীম, জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ এবং দলটির তৎকালীন ছাত্রসংগঠনের নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের (এ দুজন একই মামলার আসামি) বিরুদ্ধে মামলায়। নিজামীর মামলার রায় ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনাল-১-এ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম, ফরিদপুরের বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেন এবং ট্রাইব্যুনাল-২-এ জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাতীয় পার্টি নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মামলার রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ থাকবে। রায় ঘোষণায় বিলম্ব : নিজামীর বিরুদ্ধে মামলায় উভয় পক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলে গত বছর ৩ নভেম্বর থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত তিন দিন রাষ্ট্রপক্ষকে এবং ৬, ৭, ১০ ও ১১ নভেম্বর মোট চার দিন আসামিপক্ষকে যুক্তি উপস্থাপনের সময় নির্ধারণ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। এ আদেশের পর রাষ্ট্রপক্ষ গত বছর ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত চার কার্যদিবস যুক্তি উপস্থাপন করে। ফলে আসামিপক্ষ ৭ নভেম্বর থেকে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করে। তারা এক দিন যুক্তি উপস্থাপনের পর ১০ নভেম্বর থেকে শুরু হয় টানা হরতাল। এ কারণে আসামিপক্ষের সিনিয়র আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালে যাননি নিজামীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের জন্য। আসামিপক্ষের সিনিয়র আইনজীবীরা কয়েক দিন না যাওয়ায় ট্রাইব্যুনাল গত বছরের ১৩ নভেম্বর এক আদেশে এ মামলায় যেকোনো দিন রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখার আদেশ দেন। কিন্তু হরতাল শেষে ১৪ নভেম্বর আসামিপক্ষ ওই আদেশ রিভিউ করার আবেদন করে। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষকে পুনরায় যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ দেন। এ সুযোগ পেয়ে তারা ১৭ নভেম্বর থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত টানা তিন দিন যুক্তি উপস্থাপন করে। ২০ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করে। এরপর ট্রাইব্যুনাল ওই দিনই মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। কিন্তু রায় দেওয়ার আগেই গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর অবসরে চলে যান ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পেয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেন। সেদিনই নতুন করে যুক্তিতর্ক শোনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ১০ মার্চ প্রসিকিউশনের যুক্তি উপস্থাপনের জন্য তারিখ নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১০, ১১ ও ১২ মার্চ নিজামীর বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ড. তুরিন আফরোজ ও মোহাম্মদ আলী। অন্যদিকে ১৩, ১৯ ও ২০ মার্চ ট্রাইব্যুনালে নিজামীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন তাঁর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম ও তাজুল ইসলাম। এরপর ২৪ মার্চ ট্রাইব্যুনাল এ মামলা রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ রাখার আদেশ দেন। নিজামী গ্রেপ্তার : ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর নিজামীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এতে খুন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ১৫টি অভিযোগ ছিল। ওই বছরের ১৫ মার্চ নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি হয়। তাঁর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ না থাকায় বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল ওই দিন রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ যুক্ত করে ২০১২ সালের ২৮ মে ১৬টি অভিযোগে নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এরপর এ মামলায় ২০১২ সালের ২৬ আগস্ট থেকে গত বছরের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২৬ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে সপ্তম সাক্ষী প্রদীপ কুমার দেবকে বৈরী ঘোষণা করে তাঁকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। নিজামীর পক্ষে তাঁর ছেলে ব্যারিস্টার মো. নাজিবুর রহমান ওরফে নাজিব মোমেনসহ চারজন সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment