Friday, October 17, 2014

চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ অফিস ঘুষের আখড়া:যুগান্তর

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখা পরিণত হয়েছে ঘুষ-দুর্র্নীতির আখড়ায়। ভুয়া মালিক সাজিয়ে একজনের টাকা অন্যজনকে দেয়া, অধিগ্রহণকৃত জমির মূল্য বেশি দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে ভাগ-বাটোয়ারা, অধিগ্রহণস্থলে বসতঘরসহ অন্যান্য স্থাপনা রক্ষা করিয়ে দেয়ার নামে বাড়ির মালিকের কাছ থেকে টাকা আদায় এবং অধিগ্রহণকৃত জমির বিপরীতে মালিকের প্রাপ্য টাকা থেকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ঘুষ দিয়ে টাকা ছাড়
করা হচ্ছে। প্রতিদিন দেড় থেকে দুই কোটি টাকা ঘুষের লেনদেন হচ্ছে দালালদের মাধ্যমে। এদের সঙ্গে সখ্য রয়েছে এলএ শাখার সার্ভেয়ার, কানুনগোসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার বস্তাভর্তি টাকাসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া দালাল ইলিয়াছও একই তথ্য জানিয়েছেন। এলএ শাখা সূত্র জানায়, মহানগরী ও জেলার ১৪ উপজেলা মিলে চট্টগ্রাম এলএ অফিসে বর্তমানে ৫০টি প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রকল্পে ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ প্রদান করা হচ্ছে জমির মালিকদের। এর মধ্যে সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পের অধীন ২৩ দশমিক ৪৭ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়া হয়েছে ৫৮ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম সেনানিবাস সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পের অধীন ১ দশমিক ০৬ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এ জন্য ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ৫৭ কোটি টাকা বিলি করা হয়েছে। দক্ষিণ পতেঙ্গা আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্পের ১৫ দশমিক ০৭ একর জমির বিপরীতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২১ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এশিয়ান উইম্যান ইউনিভার্সিটিসংলগ্ন সড়ক প্রকল্পের জন্য ২৭ একর জমি অধিগ্রহণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে দেয়া হয়েছে ৯ কোটি টাকা। চাকতাই মেরিনাস বাইপাস সড়কের অধীন ২ দশমিক ৫০ একর ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের ভূমি মালিকদের ৬ ধারায় নোটিশ দেয়া হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে শূন্য দশমিক ৩০৮১ একর ভূমি বাবদ ক্ষতিপূরণ ধরা হয়েছে ৩১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে দেয়া হয়েছে ২ কোটি ৪ লাখ টাকা। সীমানা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে প্রকল্পটি বর্তমানে বন্ধ হয়ে আছে। বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী বাইপাস সড়কের জন্য ১ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে। দক্ষিণ পতেঙ্গা এলাকার বাসিন্দা নুরুল আবছার অভিযোগ করেন, জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়েছে অনেক আগে। ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে কর্মকর্তারা গড়িমসি করছেন। ক্ষতিপূরণের টাকা দ্রুত পাওয়ার জন্য সার্ভেয়ার মুরাদকে কিছু টাকাও দিয়েছি। তার পরও টাকা দেয়া হয়নি। পতেঙ্গা এলাকার বাসিন্দা নুরুল হক জানান, আউটার রিং রোড প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমির মধ্যে তার জমির টাকা আগের মালিককে বিএস খতিয়ানের ভিত্তিতে দিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ ওই ব্যক্তি অনেক আগেই জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। চাকতাই এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন, মকসুদুর রহমান, সাইদুর রহমান, মহিউদ্দিন চৌধুরী বাবুল, আনোয়ারা বেগম ও ফজলুল হক গত কয়েকমাস আগে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশনে এলএ শাখার ঘুষ দাবির অভিযোগে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এতে তারা উল্লেখ করেন, মেরিনাস বাইপাস সড়কের অধীন জমির হুকুম দখলের নামে এলএ শাখার সার্ভেয়ার কেশব লাল দে, জাহাঙ্গীর আলম, ইব্রাহিম, কানুনগো সুনীল চাকমা, চেইনম্যান নজরুল ও মোহাম্মদ আলী অধিগ্রহণের আওতায় পড়েনি এমন জমির মালিককে উচ্ছেদের নোটিশ দিয়েছেন। টাকা দিলে ওই সব স্থাপনা রক্ষা করে দেয়ারও কথা বলেন তারা। এ জন্য এলএ শাখার এসব কর্মকর্তা ভবনপ্রতি ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা দাবি করেন। এসব টাকা তৎকালীন এডিসি রাব্বি মিয়ার নামে নেয়া হচ্ছিল বলে ক্ষতিগ্রস্তদের জানিয়েছেন এলএ শাখার কর্মচারীরা। বেশ কয়েকজন জমির মালিক ভয়ে টাকা পরিশোধও করেছেন। সিসি ক্যামেরা : দালালদের দৌরাত্ম্য এত বেশি যে সার্ভেয়ার কানুনগোদের অনুপস্থিতিতে তারা তাদের চেয়ারেই বসেন। সাধারণ মানুষ দালালকে অফিসের কর্মকর্তা মনে করে প্রতারিত হন। এলএ শাখার এক কর্মকর্তা জানান, এখানকার দালালরা অত্যন্ত শক্তিশালী। দীর্ঘদিন ধরে এখানকার জমি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার কারণে সবকিছুই তাদের নখদর্পণে। ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের অভিযোগ, দালাল ছাড়া সরাসরি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করলে ওই ফাইল সহজে নড়ে না। টাকা না দিলে পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হয়। জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন জানান, বস্তাভর্তি টাকাসহ দালাল পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর দালাল উৎখাতের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এলএ শাখার প্রবেশপথসহ গুরুত্বপূর্র্ণ স্থানে ৬টি সিসি ক্যামেরা বসানো হবে। বৃহস্পতিবার থেকে ক্যামেরা বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। ফুটেজ দেখে দালালদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ১২ জনকে বদলি : বস্তাভর্তি টাকা উদ্ধারে জড়িত থাকার অভিযোগে বুধবার দুপুরে এবং রাতে দুই দফায় এলএ শাখার ১২ জনকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জন সার্ভেয়ার ও ২ জন কানুনগো। বদলি হওয়া ১০ সার্ভেয়ারের মধ্যে মোহাম্মদ নুর চৌধুরীকে রাঙ্গামাটিতে; মজিবুর রহমান, এসএম নাদিম ও শহিদুল ইসলাম মুরাদকে বান্দরবানে; আনোয়ার হোসেন, ফেরদৌস খান ও আবদুর রউফকে নোয়াখালি; সাইফুল ইসলাম পাটোয়ারী ও সুনীল কান্তি দেব মহাজনকে রাঙ্গামাটির লংগদুতে এবং আশীষ কুমার চৌধুরীকে কুমিল্লায়। দুই কানুনগোর মধ্যে আবদুল কুদ্দুসকে কুমিল্লায় এবং সুশীল বিকাশ চাকমাকে লক্ষ্মীপুরে বদলি করা হয়েছে। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) খলিলুর রহমান স্বাক্ষরিত এক আদেশে তাদের বদলি করা হয়। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল্লাহ জানান, বস্তাভর্তি আটক টাকার সঙ্গে এলএ শাখার কেউ জড়িত আছেন কিনা তা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আবুল হোসেনকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।  

No comments:

Post a Comment