Tuesday, October 14, 2014

পরীক্ষার্থীদের নিয়ে চলছে ছেলেখেলা:যুগান্তর

পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে শিক্ষা বোর্ডগুলো শৈথিল্য দেখাচ্ছে। খাতা মূল্যায়নে তাড়াহুড়ো চলছে। এতে প্রধানত শিক্ষার্থীদের কম নম্বর দেয়ার ঘটনা ঘটছে। এর বাইরে আরও চার ধরনের ভুলের শিকার হচ্ছে পরীক্ষার্থীরা। ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল আইনের সুযোগে শিক্ষা বোর্ডগুলো পরীক্ষার্থীদের প্রায় জিম্মি করে রেখেছে। জানা গেছে, উত্তরপত্রে প্রশ্নের সঠিক জবাব লেখার পরও অনেক সময় পরীক্ষকের ভুলের কারণে শিক্ষার্থীকে মাশুল
দিতে হচ্ছে। তাড়াহুড়োর কারণে পরীক্ষক একটি প্রশ্নের এক বা একাধিক অংশের উত্তরের নম্বর দিতে ভুলে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট অংশের নম্বর ছাড়া অন্যগুলো যোগ করে উত্তরপত্র বোর্ডে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে ফল বিপর্যয় ঘটছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর। উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করেও সেই নম্বর আদায় করা যাচ্ছে না। আইন অনুযায়ী উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ নেই, আছে পুনর্নিরীক্ষার। এতে প্রাপ্ত নম্বর যোগ-বিয়োগে কোথাও ভুল আছে কিনা শুধু তাই দেখা হয়। অথচ প্রশ্নের উত্তর সঠিক লেখার পরও তাকে যে অংশের নম্বর দেয়া হয়নি, ধরা পড়ার পর তা প্রকাশ করা হয় না, নম্বরও দেয়া হয় না। এজন্য কাউকে শাস্তি বা তিরস্কারের নজিরও নেই। এর দায়ও বোর্ড কর্তৃপক্ষ বহন করে না। এ দায় শুধু সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী ও তার অভিভাবকদের বয়ে বেড়াতে হয় সারা জীবন। তবে একটি প্রশ্নের চারটি অংশের নম্বর না দিলে পুনর্নিরীক্ষার সময় ওই প্রশ্নের নম্বর দেয়ার সুযোগ আছে। এর বাইরে আরও যে চার ধরনের ভুলের শিকার হয়ে থাকে, শিক্ষার্থীরা নিজ থেকে চ্যালেঞ্জ না করলে তারও কোনো প্রতিকার পায় না তারা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত পরীক্ষকদের ভুলের কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। বোর্ডের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি জানার পরও শিক্ষার্থীর প্রতি সুবিচার নিশ্চিতের কোনো ব্যবস্থা করছেন না। ফলে শিক্ষার্থীকে অন্যের ভুলের দায়ভার বহন করতে হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, এবারের এসএসসি পরীক্ষায় কেবল ঢাকা বোর্ডেই চার ধরনের ভুলের শিকার হয়েছেন অন্তত ৫৯৪ শিক্ষার্থী। এই ভুলগুলো হচ্ছে- উত্তরপত্রে দেয়া নম্বর কম যোগ করা, প্রাপ্ত নম্বর ওএমআর শিটে (মেশিনে পাঠযোগ্য ফরম) সঠিকভাবে না তোলা, ওএমআর ফরমে তোলা নম্বর অনুযায়ী বৃত্ত ভরাট না করা (যেমন : ৮০ পেল, আর বৃত্ত ভরাট করা হল ৪০) এবং কোনো প্রশ্নে নম্বর প্রদান বাদ পড়েছে কিনা। উত্তরপত্র চ্যালেঞ্জের পর ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রকৃত অবস্থা জানতে পেরেছে এবং পরে তাদের নতুন ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু যে ফল চ্যালেঞ্জ করেনি, সে আজীবনই পরীক্ষকের ভুলের দায় বহন করে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর বাইরে প্রাপ্য নম্বরের চেয়ে কম নম্বর পেয়েছে- এমন ঘটনাও অসংখ্য। কিন্তু এসব শিক্ষার্থীকে সেই প্রাপ্য নম্বর দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে বোর্ডের নীতিনির্ধারকরা বিধিমালার গ্যাঁড়াকলের অজুহাত দেখিয়ে বলছেন, বিধিমালার কারণে শিক্ষার্থীর খাতা পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ নেই। জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও পরীক্ষার ব্যাপারে কার্যকর আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির প্রধান ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ যুগান্তরকে জানান, ‘যে চার ধরনের ভুলের কথা বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থী সেগুলোর ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করলে আমরা ঠিক করে দিই। কিন্তু একবার কোনো শিক্ষার্থীকে একটি প্রশ্নে তার প্রাপ্য নম্বর ১০-এর জায়গায় ৪ দিলে সেটা ঠিক করে আর ১০ দিতে পারি না। বোর্ডের প্রবিধানমালায় এই সুযোগটি নেই বলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমাদের হাত-পা বাঁধা। এক্ষেত্রে আমাদের নিজের প্রতি নিজের দুঃখ প্রকাশের বেশি কিছু করার নেই।’ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী উত্তরপত্র চ্যালেঞ্জের যে ব্যবস্থা রয়েছে, তাতে কেবল উত্তরপত্রের পুনর্নিরীক্ষা করা হয়। এক্ষেত্রেই উল্লিখিত চারটি ভুলের শিকার শিক্ষার্থী হয়েছে কিনা, তা দেখা হয় মাত্র। কিন্তু যেসব শিক্ষার্থী নিজের ব্যাপারে আÍবিশ্বাসী, তারা খাতা চ্যালেঞ্জের যে আবেদন করে, তাতে তারা উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নই প্রত্যাশা করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব (বর্তমানে যুগ্মসচিব) সম্প্রতি ‘ম্যাট’ নামে একটি পেশাগত ও সরকারি প্রশিক্ষণে (গবেষণার অংশ হিসেবে) ঢাকা বোর্ডের পুনর্নিরীক্ষা পদ্ধতির ওপর গবেষণা করে। এতেও তারা বিষয়টি উল্লেখ করেছে। এ ব্যাপারে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসলিমা বেগম যুগান্তরকে জানান, ‘বোর্ডের প্রবিধানমালা এবং অধ্যাদেশে উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। যে কারণে কেবল পুনর্নিরীক্ষা করে থাকি আমরা। এই বিধিবিধান অনেক চিন্তাভাবনা করেই প্রণীত হয়েছে। কেননা যদি উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নেরই সুযোগ রাখা হয়, সে ক্ষেত্রে হয়তো একজন শিক্ষার্থী নতুন করে নম্বর পেয়ে উপকৃত হবে। কিন্তু এর সুযোগ নিয়ে দুর্নীতির ঘটনাও ঘটতে পারে। অসৎ উপায়ে বা বলপ্রয়োগ করে নম্বর বেশি নেয়ার রাস্তাও উম্মুক্ত হতে পারে।’ তিনি উত্তরপত্র মূল্যায়নে শৈথিল্যের অভিযোগ নাকচ করে বলেন, শিক্ষার্থীরা যাতে পরীক্ষকের ভুলের শিকার না হয়, সেজন্য খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়নে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকে। এরই অংশ হিসেবে সাধারণ পরীক্ষক এবং প্রধান পরীক্ষকের ব্যবস্থা রয়েছে। সাধারণ পরীক্ষক সব খাতা দেখে নম্বর দেয়ার পর প্রধান পরীক্ষককে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে কমপক্ষে ১০ ভাগ খাতা দেখতে হয়। ইচ্ছা করলে তিনি সব খাতাও দেখতে পারেন। তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। উল্লেখ্য, এবারের এসএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে নানা ধরনের ত্র“টি-বিচ্যুতির অভিযোগে ৪৭ পরীক্ষককে কালো তালিকাভুক্ত করেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। একই সঙ্গে আগামী পাঁচ বছর তালিকাভুক্ত এসব শিক্ষককে বোর্ডের পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই তালিকায় সবচেয়ে বেশি ইংরেজি এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ৯ জন করে মোট ১৮ জন শিক্ষক রয়েছেন। এছাড়া পদার্থবিজ্ঞানের ৮, গণিতের ৩, রসায়ন বিজ্ঞানে ৫, হিসাববিজ্ঞানে ৩, বাণিজিক ভূগোলে ১, ব্যবসায় উদ্যোগে ১, ব্যবসায় পরিচিতিতে ১, জীববিজ্ঞানে ১, বাংলায় ১, কম্পিউটার শিক্ষায় ২, সাধারণ বিজ্ঞানে ১, ভূগোলে ১ এবং ইসলাম ধর্মে ১ জন শিক্ষক কালো তালিকায় স্থান পেয়েছেন। এ ব্যাপারে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ বলেন, এসব পরীক্ষক নতুন করে নম্বর প্রদান, নম্বর যোগে, ওএমআর শিটে তুলতে বা বৃত্ত ভরাটে ভুল করে খাতা চ্যালেঞ্জের পর তাতে পুনরায় ঘষামাজা করার চেষ্টা করেছেন। এর বাইরে প্রাপ্য নম্বর থেকে (পাওয়ার উপযোগী) শিক্ষার্থীকে বঞ্চিত করার মতো বড় ধরনের অপরাধও রয়েছে। তবে কালো তালিকা প্রকাশের পর কোনো কোনো পরীক্ষক অভিযোগ করেছেন, বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী বেশি নম্বর না দেয়ায় তাদের কালোভুক্ত করা হয়েছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর একটি মহল থেকে নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ তোলা হয়। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা থাকলে সংশ্লিষ্টদের ফল প্রকাশের আগেই অভিযোগ করা উচিত। এতে ব্যবস্থা নেয়া সহজ হবে। ফল পুনর্নিরীক্ষা আর পুনর্মূল্যায়নের ব্যাপারে জানতে চাইলে শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষার বিষয়টি একটি দীর্ঘদিনের অনুশীলিত প্রক্রিয়া। এর পরিবর্তে পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যায় কিনা, সেটি আলাপ-আলোচনার বিষয়। বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকদের দাবি থাকলে আমরা কর্মশালা আয়োজন করে বিশেষজ্ঞ মতামত নিতে পারি। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।  

No comments:

Post a Comment