চিরশত্রু সাদেক হোসেন খোকাকে ‘ব্যর্থ’ প্রমাণ করে হটানো গেছে। বসা গেছে তাঁর রেখে যাওয়া বিএনপির মহানগর কমিটির আহ্বায়কের প
দেও। ফলে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তবে নতুন এই দায়িত্ব এখন তাঁর জন্য প্রবল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, হয়েছে অস্বস্তির কারণও। পরিস্থিতি এমনই যে, তাঁর সেই তৃপ্তির ঢেঁকুর এখন অম্লের জ্বালায় পরিণত হয়েছে। সরকার এবং নিজ দলের নানামুখী চাপে মির্জা আব্বাসের রাতের ঘুম হারাম। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরাগভাজন হওয়ার পাশাপাশি দলের কর্মী-সমর্থকদের কাছে তাঁর অবস্থান ক্রমে নাজুক হয়ে পড়ছে। বলা হচ্ছে, দলের প্রত্যাশিত আন্দোলন-সংগ্রামকে সামনে রেখে তিনি এখন বেশ বেকায়দায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘনিষ্ঠজনদের ইদানীং আব্বাস বলছেন, রাতে তাঁর ঘুম হচ্ছে না। কারণ একদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের পুরো দায়দায়িত্ব তাঁর মাথার ওপরে। অন্যদিকে সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়। দলের ভেতরে-বাইরে এ নিয়ে নানা আলোচনা ছড়িয়ে পড়ছে। পান থেকে চুন খসলেই চেয়ারপারসন তাঁকে রাখছেন ঝাড়ির ওপরে। গত ২২ সেপ্টেম্বর ‘না বুঝে’ হরতালের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বেশ কড়া ধমক খেয়েছেন তিনি। পরে পরিস্থিতি টের পেয়ে শেষ পর্যন্ত হরতাল দিতে রাজি হন মির্জ্জা আব্বাস। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সরাসরি মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ আনেন খালেদা জিয়া। তাঁকে উদ্দেশ করে চেয়ারপারসন জানতে চান মহানগরীর দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি কী কী কাজ করেছেন। ৮ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার অনুমতি না পাওয়ার পরও মহানগর কমিটি কেন জোরালো প্রতিবাদ করেনি তারও জবাব জানতে চান খালেদা। বৈঠকে উপস্থিত একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, ‘সরকার গুলি করছে, গ্রেপ্তার করছে’- এ ধরনের জবাব দেওয়ার চেষ্টা মির্জা আব্বাস করলেও চেয়ারপারসন ধমক দিয়ে তাঁকে থামিয়ে দেন। আব্বাসের ব্যাপারে এমন ক্ষোভ উগরে দিতে বা এতটা উত্তেজিত হতে খালেদা জিয়াকে এর আগে কখনোই দেখেননি বলে জানান ওই নেতা। এদিকে লন্ডনে বসবাসরত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দিক থেকেও আব্বাসের জন্য ভালো কোনো খবর নেই। তাঁর নেতৃত্বে ঢাকায় আন্দোলন বিষয়ে সম্প্রতি এক নেতার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে সংশয় প্রকাশ করেছেন তারেক। সরকারের সঙ্গে তাঁর আঁতাত রয়েছে কি না সে বিষয়েও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের সন্দেহ আছে বলে ওই নেতা দাবি করেন। নির্ভরযোগ্য আরেকটি সূত্রের খবর, তারেক রহমানের সঙ্গে বর্তমানে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সাদেক হোসেন খোকার ইদানীং সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে। খুব শিগগির খোকা লন্ডনে গিয়ে তারেকের সঙ্গে দেখা করবেন বলে জানা গেছে। অবশ্য মোবাইল ফোনে আলাপকালে খোকা কালের কণ্ঠকে বলেন, ছয় মাস শেষ হওয়ায় এন্ট্রি ভিসা নিতে কোনো একটা দেশে তাঁকে যেতেই হবে। আর এ জন্য তিনি যুক্তরাজ্যকেই বেছে নেবেন। তা ছাড়া লন্ডনে তাঁর ছেলে লেখাপড়া করছেন। সরকারবিরোধী আন্দোলন প্রশ্নে তিনি জানান, মহানগরী কমিটি হাতছাড়া হওয়ায় তাঁর কোনো আফসোস নেই। বরং দায়িত্ব নিয়ে আব্বাস সফল হলে তিনি খুশিই হবেন। খোকা বলেন, বাইরে থেকে অনেক কিছু বলা যায়; কিন্তু দায়িত্ব ঘাড়ে চাপলে বোঝা যায় কার কত ক্ষমতা। আর বাস্তবতাই বা কী। মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে আন্দোলন সফল হবে কি না জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য এম তরিকুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, তিনি অসুস্থ এবং এলাকায় আছেন। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্রিগেডিয়ার জে. (অব.) হান্নান শাহ বলেন, মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ই খোকার বিরুদ্ধে বেশি কথা বলতেন। এখন জুতা তাঁদের পায়ে। দেখা যাক কয় গোল করেন। তবে আগের বারের চেয়ে কিছুটা হলেও আন্দোলন হবে বলে আশাবাদী তিনি। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু উল্টো প্রশ্ন করেন, যদি আব্বাস না পারেন তাহলে আর আছেটা কে? তিনি বলেন, খোকার প্রসঙ্গ এখন বাদ, কারণ তিনি অসুস্থ। সুতরাং আব্বাসকে পারতেই হবে। মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত আবুল খায়ের ভূঁইয়া বলেন, দায়িত্ব যাঁর ওপর থাকে, সাধারণত তিনিই থাকেন ‘ফাঁপড়ে’। মির্জা আব্বাসের ওপর হয়তো এখন দায়িত্ব বেশি এসে পড়েছে। তবে আগের মহানগরী নেতারা কমিটির যে কাঠামো রেখে গেছেন, তাতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে দু-তিন বছর সময় লাগবে। তিনি বলেন, আন্দোলন কোনো ব্যক্তি বিশেষের ওপর নির্ভর করে হয় না। এটা নীতির ব্যাপার। নীতি ঠিক না থাকলে আব্বাস বা খোকাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। খোকা ব্যর্থ ও নিষ্ক্রিয়- প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে অনবরত এমন অভিযোগ ছড়িয়ে আব্বাস ও তাঁর অনুসারীরা দলের মধ্যে নিজেদের গুরুত্ব বাড়ান। এর মধ্য দিয়ে জনমনে তাঁরা এমন একটি ধারণাও তৈরি করেন যে খোকার বদলে আব্বাসকে মহানগরীর দায়িত্ব দেওয়া হলে আন্দোলন সফল হবে। তাঁরা এমন অভিযোগ করতেও ছাড়েননি যে খোকার সঙ্গে সরকারের সখ্য রয়েছে। সূত্র মতে, এভাবেই গ্রুপিং-লবিংয়ের মাধ্যমে খোকাকে কোণঠাসা করে মহানগরীর দায়িত্ব বাগিয়ে নেন মির্জা আব্বাস। প্রথমদিকে আব্বাস ততটা রাজি না থাকলে দলে ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বরকতউল্লা বুলু, গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ডেমরার সালাহ্ উদ্দিন আহম্মেদ, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও আবুল খায়ের ভূঁইয়াসহ অনেকেই তাঁকে নৈতিক সমর্থন জোগান। তাঁরা আব্বাসকে বোঝান, আগে খোকার হাত থেকে মহানগর কমিটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া দরকার। তা না হলে কেন্দ্রের রাজনীতিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সূত্রমতে, ২০১১ সালে খোকার নেতৃত্বে বিএনপির ঢাকা মহানগর কমিটি ঘোষণার পর থেকেই আব্বাস অনুসারীরা তাঁর পিছু লাগেন। ব্যাপক তৎপরতা ও গ্রপিং-লবিং শেষে গত ১৮ জুলাই তাঁরা সফল হন। সব মিলিয়ে এক রকম বাধ্য হয়েই খালেদা জিয়া গত ১৮ জুলাই খোকাবিরোধী বলে পরিচিত মির্জা আব্বাসকে মহানগর বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের একাধিক নেতা বলেন, নানামুখী তৎপরতার কারণে ‘খোকা পারেননি আব্বাস পারবেন’ এমন এক ধরনের বিশ্বাস থেকেই আব্বাস অনুসারীদের প্রাধান্য দিয়ে মহানগর কমিটি পুনর্গঠন করেন খালেদা জিয়া। ফলে নতুন কমিটিকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের ব্যাপারে বিএনপির ভেতরে-বাইরে এক ধরনের প্রত্যাশাও তৈরি হয়। বলা হয়, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সারা দেশ পেরেছে, ঢাকা পারেনি। এবার ঢাকাও পারবে। অর্থাৎ বিএনপির ঢাকাভিত্তিক আন্দোলন এখন আব্বাসের ওপরই নির্ভর করছে। কিন্তু এ প্রত্যাশা পূরণ করা যে কত কঠিন, তা গত সাড়ে তিন মাস ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মির্জা আব্বাস। একটি সূত্রের দাবি, চেয়ারপারসনের ধমকের ভয়ে পারতপক্ষে তিনি গুলশান কার্যালয়ে যেতে চান না। সূত্রমতে শুরুতেই তিনি হোঁচট খান মহানগরীর সদস্যসচিব পদে নিজের পছন্দের একজন নেতা না পাওয়ায়। স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে এ পদ দেওয়ার ঘটনা মেনে নিতে না পেরে আব্বাস সমর্থকরা তাঁর কক্ষে তালা লাগিয়ে দিয়ে খালেদা জিয়ার প্রথম বিরাগভাজন হন। পরে দলীয় চেয়ারপারসনের নির্দেশে এ নিয়োগ মেনে নিতে বাধ্য হন আব্বাস। যদিও এ নিয়ে বেশ কয়েক দিন উত্তপ্ত থাকে মহানগর বিএনপি কার্যালয়। এরপর গত ১৪ অক্টোবর ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটি ঘোষণাপরবর্তী বিদ্রোহে মহানগর বিএনপির নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। একপর্যায়ে খালেদা জিয়া নিজে আব্বাসকে ডেকে এর একটা সুরাহা করার নির্দেশ দেন। সর্বশেষ ৮ নভেম্বর রাজধানীতে জনসভা করতে না দেওয়ার পরও মহানগর বিএনপি ছিল নিশ্চুপ। এ নিয়ে দলের সর্বস্তরে প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া খোকার রাজনীতি সঠিক ছিল না- এটা প্রমাণ করতে মির্জা আব্বাস ইদানীং প্রতিটি সভা-সমাবেশে অহিংস আন্দোলনের কথা বলছেন। কারণ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে খোকা এক সমাবেশে সরকারকে মোকাবিলায় ‘দা ও কুড়াল’ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মাঠে নামতে বলেছিলেন। আব্বাস সমর্থকদের অভিযোগ ছিল, খোকা বিশেষ উদ্দেশ্যে ওই বক্তব্য দেন। যার সূত্র ধরে সহিংসতা দমনে সরকার তখন ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। তবে অহিংস আন্দোলন দিয়ে সরকারকে কতটা টলানো যাবে তা নিয়েও দলের মধ্যে এখন আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে। এদিকে সাড়ে তিন মাস পার হলেও মহানগরীর থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়নগুলোয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন এখনো সম্পন্ন হয়নি। ইউনিয়ন, থানা ও ওয়ার্ড মিলিয়ে মোট ১৮০টি কমিটি গঠন অত্যন্ত দুরূহ কাজ। যদিও সংশ্লিষ্ট নেতারা দাবি করেছেন, ৬০ থেকে ৭০ ভাগ কমিটি গঠন সম্পন্ন হয়েছে। কবে নাগাদ এ প্রক্রিয়া শেষ হবে তা নিয়ে নেতাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। মহানগরী কমিটির সদস্য কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ সম্পাদক আবুল খায়ের ভূঁইয়ার মতে, পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগবে। অন্যদিকে কমিটির এক নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, আন্দোলন সফল করতে হলে যে করেই হোক আগামী ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিটি গঠন শেষ করতে হবে। সূত্র মতে, বিদ্যমান এ পরিস্থিতির মধ্যেই মহানগর বিএনপিকে চাঙ্গা করতে প্রতি তিনটি থানায় একটি করে কর্মিসভা করার চিন্তা-ভাবনা চলছে। আর ওই সভাগুলোয় খালেদা জিয়াকে প্রধান অতিথি হিসেবে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করার কথা ভাবছেন মহানগর নেতারা। তবে অনুরোধ করলেই যে চেয়ারপারসন এসব সভায় যাবেন, সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না। অবশ্য কমিটি গঠনের চেয়ে আন্দোলনের সফলতা নিয়েই নেতারা বেশি চিন্তিত বলে জানা যায়। আর এ বিষয়টিই এখন সবচেয়ে বেশি নাস্তানাবুদ করছে মির্জা আব্বাসকে। কারণ আন্দোলন ব্যর্থ হলে শুধু খোকার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তাঁর আর পার পাওয়ার সুযোগ নেই। দায় এবার তাঁকেই নিতে হবে। আব্বাসের ঘনিষ্ঠ এক নেতা কালের কণ্ঠকে জানান, মহানগর কমিটি ঘোষণার প্রথম দিকে নেতা বেশ চাঙ্গা থাকলেও এখন অনেকটাই ম্রিয়মাণ।
No comments:
Post a Comment