মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা মো. মোবারক হোসেনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তাঁকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে সর্বোচ্চ সাজা কার্যকরের আদেশ দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল সোমবার মোবারকের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি
অভিযোগের মধ্যে দুটি প্রমাণিত হয়। এর একটিতে মৃত্যুদণ্ড ও অপরটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে বলা হয়, একাত্তরে মোবারক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার বাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিলেন। দুটি ট্রাইব্যুনাল এ পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৩টি মামলার রায় দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে গতকালই প্রথম ক্ষমতাসীন দলের কোনো সাবেক নেতার বিরুদ্ধে রায় হলো। মোবারক ২০১২ সাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ট্রাইব্যুনাল-১-এ এখন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলার রায় অপেক্ষমাণ রইল। আর জাতীয় পার্টির নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মো. কায়সারের বিরুদ্ধে মামলার রায় ট্রাইব্যুনাল-২-এ অপেক্ষমাণ রয়েছে। রায় ঘোষণার দিন ধার্য থাকায় সকালেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মোবারককে (৬৪) ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নিয়ে আসা হয়। বেলা ১১টা ১০ মিনিটে মোবারককে এজলাসে আসামির কাঠগড়ায় নিয়ে বসান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। রায়ের অন্য দিনগুলোর মতো গতকাল এজলাসে উপচেপড়া ভিড় ছিল না, বেশ কিছু আসন ছিল ফাঁকা। বেলা সোয়া ১১টার দিকে এজলাসে আসন নেন তিন বিচারপতি। রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন মোবারক: বেলা ১১টা ২০ মিনিটে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা শুরু করেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক। তিনি মোবারকের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো পড়ে শোনান। ১১টা ৪০ মিনিটে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন রায়ের পরবর্তী অংশ তুলে ধরেন। মোবারক রাজাকার ছিলেন কি না, এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন তিনি। এ সময় রায়ে বলা হয়, আসামিপক্ষের দাবি অনুসারে মোবারকের জন্মতারিখ ১৯৫৬ সালের ১ জুলাই। মুক্তিযুদ্ধকালে ১৪-১৫ বছর বয়সী ও অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মোবারকের পক্ষে রাজাকার বাহিনীর সদস্য বা নেতা হওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু মামলার নথি থেকে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের ভোটার তালিকা এবং জাতীয় পরিচয়পত্রে আসামির জন্মতারিখ ১৯৫০ সালের ১০ জানুয়ারি। এই মামলা হওয়ার আগে তৈরি হওয়া ওই ভোটার তালিকা ও পরিচয়পত্রে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কোনো কারণ আসামির ছিল না। এটা স্পষ্ট যে আসামি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ভোটার তালিকা ও পরিচয়পত্রে সত্য তথ্য দিয়েছেন। ফলে আসামিপক্ষের দাবি এখানে টেকে না। আর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও দালিলিক নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে মোবারক তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমায় গঠিত রাজাকার বাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিলেন। দুই অভিযোগে দোষী, তিন অভিযোগ থেকে খালাস: প্রথম অভিযোগ, একাত্তরের ২২ আগস্ট মোবারক ও অন্য রাজাকাররা আখাউড়ার টানমান্দাইল গ্রামের ২৬ জন ও জাঙ্গাইল গ্রামের সাতজনকে বাছাই করে তেরোঝুড়ি হাজতখানায় নিয়ে আটকে রাখে। ২৩ আগস্ট পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা ওই ৩৩ জনকে গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এই ৩৩ জনকে হত্যায় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করার দায়ে ট্রাইব্যুনাল মোবারককে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেন। তৃতীয় অভিযোগ, একাত্তরের ১১ নভেম্বর রাতে মোবারক তাঁর সশস্ত্র রাজাকার সহযোগীদের নিয়ে আখাউড়ার ছাতিয়ান গ্রামের আবদুল খালেককে অপহরণ করে সুহিলপুর ইউনিয়নের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান এবং সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করেন৷ ওই রাতেই খালেককে তিতাস নদের পশ্চিম পাড়ে বাকাইল ঘাটে নিয়ে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়৷ এ অভিযোগে হত্যা, আটক ও নির্যাতনে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করার দায়ে মোবারককে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এগুলো থেকে খালাস পান মোবারক। এ অভিযোগগুলো হলো একাত্তরের ২৮ অক্টোবর আখাউড়ার শিমরাইল গ্রামের আশুরঞ্জনকে হত্যা, ৬ ডিসেম্বর খড়মপুর গ্রামের খাদেম হোসেন খান ও আমিরপাড়া গ্রামের মো. সিরাজকে হত্যা এবং অপহরণের পর আটক রাখা ও নির্যাতনের অভিযোগ। চূড়ান্ত আদেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, যেহেতু আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এ জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ৯২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের সারসংক্ষেপ পড়া শেষ করেন ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষের সন্তোষ, আপিল করবে আসামিপক্ষ: মোবারকের ফাঁসির আদেশের পর প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সাহিদুর রহমান বলেন, তাঁরা এ রায়ে সন্তুষ্ট। পূর্ণাঙ্গ রায় বিশ্লেষণ করার পর খালাস হওয়া তিন অভিযোগের বিষয়ে আপিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আসামিপক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলামের দাবি, তাঁরা ন্যায়বিচার পাননি। মোবারক মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মতো কোনো অপরাধ করেননি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। মোবারকের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হওয়ায় সন্তোষ জানিয়েছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১। গতকাল এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, ট্রাইব্যুনালের রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে যাঁরাই যুক্ত দলমত-নির্বিশেষে তাঁদের শাস্তি নিশ্চিত হওয়া উচিত। এই রাজাকার একাত্তরের জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও পরে তিনি আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় অবস্থান করে নিজের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করেছিলেন। মোবারককে যে তিন অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে সেগুলোতে সর্বোচ্চ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষকে আপিল করার অনুরোধ করেছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। চেতনার মুক্তিযুদ্ধ নামে একটি সংগঠন মোবারকের মৃত্যুদণ্ডাদেশকে স্বাগত জানিয়েছে।
No comments:
Post a Comment