Saturday, November 8, 2014

আলোহীন চোখে মনের দৃঢ়তা:প্রথম অালো

স্কুলঘরের বারান্দায় ছয়টি দাবার বোর্ড সাজানো। মুখোমুখি বসে নিবিষ্টমনে চাল দিচ্ছে কয়েকটি ছেলেমেয়ে। তাদের আলোহীন চোখের দৃষ্টি দাবাকে ঘিরে। চাল দিতে দিতে মোহাম্মদ তুষার দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়ে দিল তার লক্ষ্য, ‘আমি গ্র্যান্ডমাস্টার হতে চাই।’  দোতলার বারান্দা থেকে নিচের মাঠে চোখ গেল। সেখানে আরেকটি দল মগ্ন ক্রিকেটে। কখনো ‘হাউ ইজ দ্যাট’, কখনো বা চার-ছক্কার চেঁচামেচি। শব্দযুক্ত বল দিয়ে চলছে খেলা। তাদের
সাফল্যও আছে। এই স্কুলেরই দুই প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবার দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠেয় বিশ্ব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নেবে। শুধু খেলাধুলা নয়, চট্টগ্রামের সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায়ও এগিয়ে। ২০১৩ সালে এই বিদ্যালয় থেকে তিনজন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সবাই পাস করেছে। একই বছর জেএসসি পরীক্ষায় পাস করে চারজন, অংশ নিয়েছিল সাতজন। শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও এগিয়ে যাচ্ছে আলোহীন এসব কিশোর-কিশোরী। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মো. আবদুস সামাদ বলেন, ‘আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলাও চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। ক্রীড়া সংগঠক দিদারুল আলম চৌধুরী বেশ কিছু সরঞ্জাম দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছেন। তা দিয়েই তারা খেলাধুলা চালিয়ে যাচ্ছে।’ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ তুষার ও তার তিন সহপাঠী ঢাকায় সদ্যসমাপ্ত দ্বিতীয় বিভাগ দাবায় কৃতিত্ব অর্জন করেছে। স্বাভাবিক প্রতিযোগীদের সঙ্গে তাদের দল ‘দ্য ব্লাইন্ড কিং অব চিটাগং’ ২৩ দলের মধ্যে ১৩তম হয়েছে। এই চার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এখন আরও বড় স্বপ্ন দেখে। ঢাকায় দ্বিতীয় বিভাগ দাবায় অংশ নেওয়া অন্য শিক্ষার্থীরা হলো অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সুরত আলী, ষষ্ঠ শ্রেণির আবিদুর রহমান ও রাহি চৌধুরী। সুরত আলী তার বিদ্যালয়ে দাবায় চ্যাম্পিয়ন। গতবার চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত দাবা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয় সে। সেবার এই বিদ্যালয়ের অপর শিক্ষার্থী ফয়সাল হয়েছিল চতুর্থ। সুরত জানায়, ‘প্রথমবারের মতো বড় কোনো প্রতিযোগিতায় খেলেছি। এটা আমাদের জন্য দারুণ রোমাঞ্চকর একটি ব্যাপার। আমরা অনেক মজা করেছি। আমি দৃষ্টিহীনদের বিশ্ব দাবা আসরে খেলতে চাই।’ খেলার পাশাপাশি পড়ালেখাও ভালোভাবে চালিয়ে যেতে চায় কক্সবাজারের এই শিশুটি। বড় হয়ে সে আইনজীবী হতে চায়। তার সহপাঠী আবিদুর রহমান উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি দাবায় জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আবিদুর জানায়, ‘ঢাকায় স্বাভাবিক প্রতিযোগীদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছে। ঘড়ি ঠিকমতো টিপ দিতে পারি না আমরা। তবে এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগীরা আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছে।’ ছেলেদের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও দাবাচর্চায় মগ্ন থাকে। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী রিতা আক্তার জানায়, ‘স্কুলে আমরা ছেলেমেয়েরা একসঙ্গেই খেলছি। এখন আমরাও ছেলেদের মতো বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে চাই।’ নগরের মুরাদপুরে অবস্থিত এই বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। বর্তমানে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৪ জন। এর মধ্যে ৩৩ জনই মেয়ে। ক্রিকেটের বিশ্ব আসরে: শুধু দাবা নয়, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্রিকেট ও ফুটবলও খেলে। আগামী ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠেয় বিশ্ব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নেবেন এই স্কুলের প্রাক্তন দুই শিক্ষার্থী। তাঁরা হলেন বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ের ছাত্র সোলায়মান বাদশা ও রিপন বড়ুয়া। রিপন নগরের একটি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে চাকরিও করেন। সোলায়মান বলেন, ‘বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের হয়ে আমরা খেলতে যাব। এখন ঢাকায় অনুশীলন করছি। স্কুল থেকেই আমি ক্রিকেট খেলি। দেশের জন্য যাতে সম্মান বয়ে আনতে পারি, সেই দোয়া করেন।’ লেখাপড়ায় সাফল্য: এই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী তৌফাতুর রাব্বি এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয় নিয়ে পড়ছেন। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া এই ছাত্রের সাফল্যগাথা পাঠ্য হয়েছে ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে। ষষ্ঠ শ্রেণির কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা বইয়ে ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রাব্বির জবাব’ শিরোনামে লেখাটি রয়েছে। এখানকার আরও বেশ কয়েকজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে পড়ছেন। পাস করেও বেরিয়েছেন কয়েকজন। পড়ালেখা-খেলাধুলার পাশাপাশি গানবাজনাও করে থাকে স্কুলের শিক্ষার্থীরা। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তন্ময় দত্ত ও ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী রিপা আক্তার নিয়মিত বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রে গান করে।

No comments:

Post a Comment