Tuesday, November 25, 2014

আ. লীগ-জামায়াত নেতারা আরএসওর পৃষ্ঠপোষক!:কালের কন্ঠ

মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কয়েকটি জেলা নিয়ে আরকানিস্তান (আরকান) নামের একটি স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নদ্রষ্টাদের মহ
াপরিকল্পনার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রভাবশালী কিছু রাজনীতিবিদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) বান্দরবান ও কক্সবাজারের স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও জামায়াত নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এমন ভয়াবহ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুর দিকে বান্দরবান থেকে গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছিল প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে। কিন্তু ওই প্রতিবেদনের আলোকে প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বলে জানা গেছে। গত রবিবার ওই প্রতিবেদনে নাম উল্লেখ থাকা দুই ব্যক্তি জঙ্গি সন্দেহে চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার হওয়ার পর গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনটি সামনে চলে আসে। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের হাতে ধরা পড়া সালামত উল্লাহ ও মোহাম্মদ শফিউল্লাহর সঙ্গে ওই দিন গ্রেপ্তার হয় পাকিস্তানি নাগরিক মোহাম্মদ আলমসহ আরো তিনজন। এদের মধ্যে হাফেজ সালামত উল্লাহ কক্সবাজার জেলা জামায়াতের নেতা। আর মোহাম্মদ শফিউল্লাহ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। এর মধ্যে কক্সবাজারে সালামতের পরিচালিত মাদ্রাসায় গতকাল সোমবার অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। ওই প্রতিবেদনের একাংশে বলা হয়েছে, আরএসও সংগঠনটির জন্ম ১৯৮০ সালে রাবেতা আল আলম আল ইসলামীর মদদে। জনৈক ড. মো. ইউনুছ রোহিঙ্গা প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট (আরপিএফ) নামে প্রথমে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে এটি আরএসও নাম ধারণ করে। ২০১২ সালের জুলাই মাসে উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, আরএসওর সঙ্গে আল-কায়েদাসহ আরো কয়েকটি জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগাযোগ রয়েছে। আরএসওর নিজেদের কৌশলপত্র, মানচিত্র, পতাকা ও সংবিধান রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাটির ওই প্রতিবেদনে আরএসওর সঙ্গে বান্দরবান ও কক্সবাজারের কয়েকজন আওয়ামী লীগ ও জামায়াত নেতা জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য তুলে ধরা হয়। আরএসও সদস্যরা কিভাবে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করছে এবং বাংলাদেশে এনজিও সংস্থার ছদ্মাবরণে কিভাবে সংগঠিত হচ্ছে সেসব তথ্যও রয়েছে প্রতিবেদনে। পাশাপাশি সংগঠনের নেপথ্যে যারা কাজ করছে তাদের অনেকের নামও তুলে ধরা হয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে বান্দরবান থেকে ঢাকায় পাঠানো ওই প্রতিবেদনের একাংশে লেখা হয়েছে, ‘সরকারি দল ও জামায়াতসম্পৃক্ত সদস্য রয়েছে।’ তবে তালিকায় সংশ্লিষ্ট নেতাদের নাম ও রাজনৈতিক পরিচয় পাশাপাশি লেখা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবেদনভুক্ত নামের মধ্যে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ শফিউল্লাহ এবং ওলামা লীগের মৌলানা নজির, নাইক্ষ্যংছড়ির ডা. মোস্তফা কামাল লালু এখন সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আবার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি হাফেজ মোতাহের, বায়তুল-মাল সম্পাদক আবু মুছা কুতুবীও আরএসওর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ২০০২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর এশিয়া টাইম সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, আরএসওর বিভিন্ন প্রকাশনা যাচাই এবং এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে আরএসও সীমান্ত এলাকায় লিফলেট ছাপিয়ে আরকানিস্তান (আরকান) নামক একটি স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের মহাপরিকল্পনার কথা ঘোষণা করে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের ফেনী থেকে শুরু করে পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের সাবেক আরাকান রাজ্যের মংডু, বুচিদং ও ক্যালাডং জেলা অঞ্চল নিয়ে আরকানিস্তান গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আরএসও নেতারা কাজ করছেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মিয়ানমার (বার্মা) থেকে বাংলাদেশে আসা ব্যক্তিরাই এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বর্তমানে এদের অনেকেই বাংলাদেশি নাগরিক। চলতি বছরের শুরুতে লেখা প্রতিবেদনে বলা হয়, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তবর্তী একটি উপজেলা। এর উত্তর-পশ্চিমে কক্সবাজারের রামু উপজেলা ও দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার সীমান্ত। এ উপজেলার ১২০ কিলোমিটার সীমান্ত দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ার সুযোগে কয়েক যুগ ধরে মিয়ানমারের কয়েকটি স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী সংগঠন এখানে তৎপরতা শুরু করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে বসতি গড়ে তোলা প্রভাবশালী কিছু রাজনীতিক ও বিত্তশালী ওই সব রোহিঙ্গা যুবক দ্বারা পরিচালিত আরএসও সংগঠনটিকে আর্থিক ও প্রশাসনিকভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন ড. মো. ইউনুছ, নুরুল ইসলাম, এজাহার হোসেন, হাফেজ ছানাহুল ও আলহাজ শফিউল্লাহ। এই শফিউল্লাহই গত রবিবার চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়া ড. মো. ইউনুছ বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া হাফেজ সালেহ, আলহাজ হাবিবুল্লাহ, ছৈয়দ আলম, হাফেজ আহমদ চেরাগ, ডা. আলম, মৌলভি সেলিম, ডা. মোস্তফা, ডা. মোস্তফা কামাল লালু, মৌলভি নুরুল ইসলাম, আরিফ উল্লাহ, নুর হোসেন, মৌলভি নজিরসহ ৫০ জনের বেশি সদস্যের নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী দোছড়ি ইউনিয়নের আরএসও মূল ঘাঁটির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের এই অংশে বলা হয়েছে, এসব সদস্যের (আরএসও) মধ্যে সরকারি দল ও জামায়াতসম্পৃক্ত সদস্য রয়েছেন। উল্লিখিত ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য কেউ আরএসওর মূল অবস্থানস্থলে অবাধে যাতায়াত করতে পারে না বলে দোছড়ি এলাকার একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দোছড়ি সীমান্তে আরএসওর ২০০ থেকে ২৫০ সামরিক সদস্য রয়েছে। তারা পৃথকভাবে দোছড়ি ইউনিয়নের ক্ষুরিক্ষ্যং থেকে টেংরাটিলা (কালো পাহাড়) ইংলং পাড়া পর্যন্ত এলাকাজুড়ে অবস্থান করছে। তারা দুর্গম পাহাড়ে অবস্থান করে নিজেদের কার্যক্রম চালায়। তাদের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে বলে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গোয়েন্দারা সরেজমিনে জেনেছেন, দোছড়ি ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে আরএসওর তৎপরতা সম্পর্কে কিছু তথ্য মিললেও তারা প্রকাশ্যে কোনো তথ্য দিতে নারাজ। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, আরএসও ঈদ ও রমজানে এলাকার মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে। এ ছাড়া ইন্টিগ্রেটেড হিউম্যান অ্যাপ্রোচ, মানবকল্যাণ, করুণা নামের এনজিওসহ বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে স্থানীয়দের নানা রকম সাহায্য-সহযোগিতা দেয়। আরএসও পরে সে-সংক্রান্ত ছবি ও খবরাখবর বহির্বিশ্বে পাঠিয়ে দেয়। গ্রেপ্তার পাঁচজন পাঁচদিনের রিমান্ডে : চট্টগ্রামের জিইসির মোড় এলাকার আবাসিক হোটেল থেকে গত রবিবার দুপুরে গ্রেপ্তার হওয়া সন্দেহভাজন পাঁচ জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আহমেদ সাঈদ। গতকাল সোমবার দুপুরে শুনানি শেষে আদালত এ আদেশ দেন। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে উচ্চ পর্যায়ের আরো একটি কমিটি চট্টগ্রামে আসছে বলে জানা গেছে। রিমান্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন পাকিস্তানের করাচির বাসিন্দা মোহাম্মদ আলম (৪৫), মোহাম্মদ আমিন (৫০), আব্দুল মজিদ (৩০), ছালামত উল্লাহ (৪৫) ও শফিউল্লাহ (৪০)। তাঁদের মধ্যে ছালামত উল্লাহ জামায়াত নেতা এবং শফিউল্লাহ আওয়ামী লীগ নেতা। তাঁদের মধ্যে ছালামত উল্লাহ ও মোহাম্মদ শফিউল্লাহ মায়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সভাপতি ও সহসভাপতি হিসেবে কাজ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কক্সবাজারে সালামতের মাদ্রাসায় তল্লাশি : কক্সবাজার অফিস জানায়, চট্টগ্রামে রবিবার জঙ্গি সন্দেহে আটক পাঁচজনের মধ্যে আরএসও সভাপতি হাফেজ সালামতুল্লাহ পরিচালিত কক্সবাজারের মাদ্রাসাটিতে গতকাল পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে। কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের দক্ষিণ মুহুরীপাড়া এলাকায় সরকারি বিশাল এলাকাজুড়ে এই আরএসও জঙ্গি ছয় বছর আগে গড়ে তোলেন আদর্শ শিক্ষা নিকেতন নামের এই মাদ্রাসা। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার নেপথ্যের উৎস নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে বরাবরই কৌতূহল রয়েছে। এখানে প্রায়ই বিদেশি লোকজনের আগমন ঘটে। সন্ধ্যার পর বসে বৈঠক। এরই মধ্যে গতকাল প্রতিষ্ঠানটিতে আকস্মিক পুলিশি অভিযানের সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা পালিয়ে যায়। পুলিশ মাদ্রাসার কিছু কাগজপত্র জব্দ করেছে। স্থানীয়রা জানায়, সৌদি আরব, পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন সংস্থার অর্থায়নে চলছে মাদ্রাসাটি। মূলত রোহিঙ্গাদের পড়ালেখা করানোর জন্যই এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখানকার ৩০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৭০ জনই মিয়ানমারের নাগরিক। স্থানীয় মুহুরীপাড়ার বাসিন্দা বেলাল জানান, মাদ্রাসার ১৩ জন শিক্ষকের ১১ জনই মিয়ানমারের নাগরিক। এই মাদ্রাসাকে ঘিরে এলাকায় অবৈধ রোহিঙ্গা বসতিও বেড়েছে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান (১৬) জানায়, মিয়ানমার থেকে এক বছর আগে কক্সবাজারে এসে এ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে সে। অন্য এক শিক্ষার্থী আনিস জানায়, ২০১২ সালে মিয়ানমারে দাঙ্গার পর কক্সবাজারে পালিয়ে আসে সে। পরে এই মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তার সব ব্যয় বহন করে। মাদ্রাসাটির পরিচালক আসলাম জানান, ১৩ জন শিক্ষকের দ্বারা তিন শতাধিক শিক্ষার্থীকে মাদ্রাসা শিক্ষা দেওয়া হয়। এরা সবাই কক্সবাজারের বাসিন্দা। তবে এর পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি তিনি। শিক্ষক কামাল হোসেন দাবি করেন, এখানে কয়েকজন রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী থাকলেও অধিকাংশই টেকনাফ ও উখিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা। কক্সবাজার সদর থানার ওসি মাহফুজুর রহমান জানান, মাদ্রাসাটির ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তদন্তপূর্বক এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। গতকাল অভিযান পরিচালনা শেষে সদর থানার উপপরিদর্শক ফারুক জানান, প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পরিচয়, বইপত্র, মাদ্রাসার বিভিন্ন কাগজপত্র দেখা হয়েছে। কিছু কাগজপত্র জব্দও করা হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্য মতে, সালামত আফগান ও লিবিয়া থেকে জঙ্গি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তিনি মিয়ানমারের বুচিদং এলাকার থামিংচং গ্রামের হামিদ হোসেনের ছেলে। ১৯৯২ সালে তিনি প্রথম বাংলাদেশে আসেন। ১৯৯৪ সালে তিনি আফগানিস্তানে যান। সেখান থেকে লিবিয়া হয়ে সৌদি আরবে কিছুদিন থাকেন। এরপর বাংলাদেশে ফিরে আসেন ২০০৪ সালে।

No comments:

Post a Comment