Thursday, November 6, 2014

২২ টাকার গাদ মিশিয়ে ৯৯ টাকার অকটেন!:কালের কন্ঠ

অকটেন ও পেট্রলে উচ্চমাত্রায় সিসাযুক্ত কনডেনসেট (গ্যাসের সহজাত) মেশানো হচ্ছে। জ্বালানি তেলে ভেজাল মেশানোর ফলে তেলচালিত
গাড়িসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, পরিবেশের ভয়াবহ দূষণও ঘটছে। কনডেনসেট থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদনের অনুমতি পাওয়া বেসরকারি কম্পানিগুলো ভেজাল মেশানোর এ গর্হিত কাজটি করছে। আর এসব ভেজাল জ্বালানি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীন তেল বিতরণ কম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার চোখ এড়িয়ে পৌঁছে যাচ্ছে সারা দেশে। বেশ কয়েকটি কম্পানির ব্যাপারে অভিযোগ, কানাঘুষা থাকলেও গোয়েন্দা অনুসন্ধানে বারবার একটি কম্পানির নাম উঠে আসছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কম্পানিটির ব্যাপারে বিশদ তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে ভেজাল জ্বালানি বিক্রি করে ওই প্রতিষ্ঠান এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা আয় করেছে। বিপিসি, জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তর এ বিষয়ে অবগত থাকলেও তারা দফায় দফায় বৈঠকই করে কেবল। কিন্তু অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। তবে সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ প্রতিবেদনের পর জ্বালানি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাসের সহজাত হিসেবে কনডেনসেট উৎপন্ন হয়। গ্যাসের এই উপজাত পরিশোধন করে অকটেন, পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন প্রভৃতি পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করা হয়। কনডেনসেট থেকে পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদনের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) রয়েছে। এর বাইরেও সরকার পাঁচটি বেসরকারি কম্পানিকে এ দায়িত্ব দিয়েছে। এসব বেসরকারি কম্পানি কনডেনসেট থেকে অকটেন, পেট্রলসহ বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করে। পেট্রল, অকটেন, ডিজেল ও কেরোসিন খোলাবাজারে বিক্রি করার কোনো বিধান নেই। এসব জ্বালানি বিপিসির তিন কম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার কাছে বিক্রি করে কম্পানিগুলো। বেশি মুনাফার আশায় কিছু বেসরকারি কম্পানি উচ্চ মাত্রায় সিসাযুক্ত কনডেনসেট সরাসরি অকটেন ও পেট্রলে মেশাচ্ছে। সেই ভেজাল জ্বালানি তেল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পেট্রল পাম্পগুলোয় গোপনে বিক্রি করা হচ্ছে। গোয়েন্দারা সম্প্রতি কনডেনসেট মিশ্রণকারী একটি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে। কম্পানিটি চট্টগ্রামের, নাম সুপার রিফাইনারি কম্পানি লিমিটেড। জানা গেছে, অকটেন ও পেট্রলে কনডেনসেট মেশানোর উদ্দেশ্য মুনাফা সর্বোচ্চকরণ। এক লিটার কনডেনসেটের দাম গড়ে ২২ টাকা। আর এক লিটার পেট্রলের দাম ৯৪ টাকা ও অকটেনের ৯৯ টাকা। মুনাফার লোভেই অকটেন ও পেট্রলের সঙ্গে কনডেনসেট মেশানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। বেসরকারি কম্পানিগুলো জ্বালানি তেলে কনডেনসেট মিশিয়ে গোপনে বিক্রি করছে বলে স্বীকার করেন বিপিসির চেয়ারম্যান ইউনুচুর রহমান। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন বেসরকারি কম্পানিগুলোর কাছ থেকে তেল নিচ্ছি তখন কিন্তু তেলের মান পরীক্ষা করে নিই। কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান তেলে কনডেনসেট মিশিয়ে গোপনে বিক্রি করছে।’ তিনি বলেন, ‘তেলে ভেজাল মেশানো মারাত্মক অপরাধ।’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। তেলে কনডেনসেট মেশানোর অভিযোগ ওঠায় সুপার রিফাইনারি কম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আহমেদের কাছে জানার জন্য তাঁর দুটি মুঠোফোনে কল করে বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আসলাম হায়দার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কিছু ভুঁইফোড় কম্পানিকে কনডেনসেট থেকে জ্বালানি তেল ও অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে। তারাই ঘুষ দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে এসব প্রতিবেদন করিয়েছে। এর কোনো ভিত্তি নেই।’ জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি তেলে ভেজাল নিয়ে গত ৪ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিপিসি, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি বৈঠক হয়। তবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। শক্তিশালী সিন্ডিকেট, সরকার নিশ্চুপ : জ্বালানি তেলে ভেজাল দেওয়ার অভিযোগের বিষয়টি সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করে। তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০১ সাল থেকে জ্বালানি তেলে ক্ষতিকর কনডেনসেট মিশিয়ে আসছে সুপার রিফাইনারি। বিভিন্ন সময়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় তদন্ত করে প্রতিষ্ঠানটিকে দোষী সাব্যস্ত করলেও তেলে ভেজাল দেওয়া ঠেকানো যায়নি। সুপার রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আহমেদ, চেয়ারম্যান লুৎফুননেছা, পরিচালক প্রনব কুমার সাহা ভেজাল মিশ্রণের কাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। এসব ভেজাল জ্বালানি তেল সারা দেশে বিক্রির দায়িত্বে রয়েছেন জিএম (সেলস) দিদার, জিএম (কমার্শিয়াল) সুব্রত ও সেলস অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট ম্যানেজার রেহানা ফেরদৌস। অভিযুক্তদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে সুপার রিফাইনারি ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। জানতে চাইলে সুপার রিফাইনারির সাবেক পরিচালক প্রনব কুমার সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অভিযোগটি অনেক পুরনো। কিন্তু প্রমাণ করা যায়নি যে সুপার রিফাইনারি তেলে ভেজাল দিয়ে থাকে। আর আমি এর সঙ্গে যুক্ত নই। ওই প্রতিষ্ঠানেও আমি এখন নেই।’ গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কেন আপনার নাম এসেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আমার নাম আসতে পারে। কিভাবে এলো জানি না। তবে মাঠপর্যায়ে আমার সম্পর্কে খোঁজ নিলে ভালো তথ্য পাবেন।’ জানা গেছে, কনডেনসেট ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য ১৯৯৭ সালের ১ অক্টোবর সিলেট গ্যাসফিল্ডের সঙ্গে দেশের প্রথম কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়। চুক্তির শর্তে বলা হয়, কনডেনসেট সলভেন্ট (জ্বালানি তেলসহ পেট্রোপণ্য) প্রস্তুতের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হলে সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেডের অনুমতি নিতে হবে। কনডেনসেট বা এর প্রোডাক্টস প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জ্বালানি হিসেবে ডিলার, এজেন্ট ও বিক্রেতার কাছে সরবরাহ বা বিক্রি করা যাবে না। গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সুপার রিফাইনারি সিলেট গ্যাসফিল্ড থেকে দৈনিক ৩৫ থেকে ৪০ ট্যাংকলরি কনডেনসেট পায়। এর অর্ধেক পথেই বিভিন্ন পেট্রল পাম্পে বিক্রি করে দেয়। বাকি অর্ধেক কনডেনসেট থেকে পেট্রল, অকটেন, ডিজেল ও অন্যান্য পেট্রোপণ্য তৈরি করে তারা। রঙের কাঁচামাল তারপিন (এমটিটি বা মিনারেল তারপিন) উৎপাদন করে সুপার রিফাইনারি। কাগজ-কলমে অনেক এমটিটি উৎপাদন করার কথা বলা হলেও বাস্তবে সামান্য পরিমাণ এমটিটি এলিট পেইন্টে সরবরাহ করা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, সুপার রিফাইনারির কনডেনসেট বাজারে বিক্রির জন্য একটি বিশাল চক্র আছে। চট্টগ্রামের মেককো ফিলিং স্টেশন, আহসানের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের চৌধুরী ব্রাদার্সের পেট্রল পাম্প, চট্টগ্রামের রফিক, চান্দগাঁওয়ের শিহাব, মাসুদের নেতৃত্বে বাদশা মিয়া পেট্রল পাম্প, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের নাহার পেট্রল পাম্প, হারুন, খালেক সাহেবের কর্ণফুলী পেট্রল পাম্প, মোখলেচুর রহমান, শামিম, দুলাল, দুলু ও হারুনুল ইসলাম এ চক্রে রয়েছেন। হারুনুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানের এমডি সেলিম আহমেদের বন্ধু ও এলিট পেইন্টের ডিএমডি আর মাসুদ এমডির শ্যালক। মোখলেচুর রহমানের মাধ্যমে ঢাকায় ভেজাল তেল বিভিন্ন পেট্রল পাম্পে পৌঁছে দেওয়া হয়। মানবদেহের ক্ষতি, যন্ত্রপাতি অকালে নষ্ট : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ সিসাযুক্ত ভেজাল তেলের কারণে মূল্যবান গাড়ি নষ্ট হচ্ছে। আর সৃষ্ট ধোঁয়া মানবদেহের অপূরণীয় ক্ষতি করছে। কনডেনসেট মেশানো জ্বালানি দিয়ে গাড়ি চালালে গাড়ির ইঞ্জিন কাঁপে এবং দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ম তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কনডেনসেট মিশ্রিত জ্বালানি তেল বাংলাদেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে। তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতিও হচ্ছে।’ তিনি বলেন, জ্বালানি তেলে বিশেষত পেট্রলে যে ভেজাল দেওয়া হচ্ছে তার দায় বিপিসির। এ দায় তাদের নিতে হবে। জানা গেছে, জ্বালানি তেলে ভেজাল নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি হয় ২০০১ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কমিটির প্রতিবেদনে সুপার রিফাইনারির বিরুদ্ধে জ্বালানি তেলে কনডেনসেট মেশানোর অভিযোগ আনা হয়। সেবার প্রভাবশালী মহলের তদবিরে পার পেয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। ওই তদন্ত কমিটির সদস্য আবদুল ওয়াদুদ খান এখন সুপার রিফাইনারির পরিচালক (অপারেশন)।

No comments:

Post a Comment