Thursday, November 6, 2014

উদ্যোক্তার খোঁজে আর্থিক প্রতিষ্ঠান:নয়াদিগন্ত

পসরা নিয়ে বসেছেন দোকানদার। ক্রেতা তাদের চাহিদানুযায়ী পণ্য কিনে নিচ্ছেন, কিন্তু পসরা নিয়ে ক্রেতার কাছেই আসছেন দোকানদার। এ অবস্থা হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে। আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানত নিচ্ছে, কিন্তু উদ্যোক্তার অভাবে তা বিনিয়োগ করতে পারছে না। এমনকি বিদ্যমান উদ্যোক্তাদেরও কম সুদে বিনিয়োগ দেখিয়ে ভাগিয়ে নিচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এমন পরিস্থিতিতে মহা বিপাকে পড়েছে দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প
্রতিষ্ঠানগুলো। অনেকেই নতুন উদ্যোক্তা খুঁজছে। বাধ্য হয়ে বিকল্প বিনিয়োগের দিকে ছুটছে তারা। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ থেকে সরে এসে কেউ কেউ স্বল্প মেয়াদে বিনিয়োগ করার চেষ্টা করছে।   আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকজন শীর্ষ নির্বাহী এ তথ্য জানান। তারা আরো জানান, যেসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ আছে এবং সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা বিপাকে আছে সবচেয়ে বেশি। কারণ এক দিকে বিনিয়োগ স্থবিরতার মাঝে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় আয় কমে যাচ্ছে, অন্য দিকে পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক মন্দার কারণে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলো ধারাবাহিকভাবে লোকসান গুনছে। দুই দিকের লোকসান সমন্বয় করা তাদের জন্য এখন অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।   এদের একজন জানান, বিনিয়োগ স্থবিরতার সুযোগে দীর্ঘ দিনের ভালো ভালো গ্রাহককে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ভাগিয়ে নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এতে বিদ্যমান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যমান বিনিয়োগ আরো কমে যাচ্ছে। বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় সরাসরি মুনাফার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কিন্তু কমছে না পরিচালন ব্যয়। এ পরিস্থিতিতে কম সুদে আমানত নিয়ে ব্যয় কমানোর জন্য বেশি সুদের আমানত পরিশোধ করা হচ্ছে। কিন্তু নতুন করে বিনিয়োগ না থাকায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের। আবার যারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ নিয়েছেন, তারা ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থবিরতার কারণে ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এক দিকে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না, ভালো বিনিয়োগ প্রত্যাহার হচ্ছে, অন্য দিকে ঋণ আদায় না বাড়ায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে মহাবিপাকে। তিনি বলেছেন, সঠিকভাবে ঋণের নিরাপত্তা সঞ্চিতি অর্থাৎ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হলে সব প্রতিষ্ঠানেরই লোকসান হবে।   একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আয় না বাড়লেও বিদ্যমান পরিচালন ব্যয় কমছে না, বরং ক্ষেত্রবিশেষ বেড়ে যাচ্ছে। এর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিধিনিষেধ পরিপালন করতে গিয়ে অনেকেই পড়েছে মহাবিপাকে। বেঁধে দেয়া সময় পার হলেও প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি তিনটি প্রতিষ্ঠান। সব মিলে ব্যাংকবহির্ভূত এসব প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকাই যেন এখন বড় সফলতা হিসেবে দেখা দিয়েছে।   জানা গেছে, বর্তমানে ৩১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটি সরকারি, ২০টি বেসরকারি ও আটটি দেশী-বিদেশী মালিকানায় পরিচালিত। সম্প্রতি নতুন আরো দু’টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সব মিলে বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩টি। সারা দেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২০০টি শাখা রয়েছে।   জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের মতো সরাসরি আমানত সংগ্রহ করতে পারে না। ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে সরাসরি আমানত সংগ্রহ করতে পারে; কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তিন মাসের কম সময়ের জন্য সরাসরি আমানত সংগ্রহ করতে পারে না। এ কারণে আর্থিক গ্রাহকেরা ব্যাংকেই আমানত রাখে বেশি। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেউ আমানত রাখলেও ব্যাংকের চেয়ে বেশি মুনাফা দাবি করে। ব্যাংক ১২ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশে আমানত পেলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ১৬ থেকে ১৭ শতাংশের কমে আমানত সংগ্রহ করতে পারে না। এখন অবশ্য বিনিয়োগ মন্দা ও তারল্য সঙ্কট না থাকায় ১১ থেকে ১২ শতাংশে মিলছে আমানত।   এ দিকে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঙ্কট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে এত দিন বিনিয়োগের মন্দা ছিল। মন্দার কারণে অনেকেই ঋণ নিয়ে তা ফেরত দিতে পারেনি। এর ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ বেড়ে গিয়েছিল; কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের কোনো ভরসাই পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। অপর এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি গতকাল নয়া দিগন্তকে জানান, নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই। চলমান বিনিয়োগেও ভাটা পড়ে গেছে। বিনিয়োগ স্থবিরতার সুযোগ নিয়ে ব্যাংকগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভালো গ্রাহককে ভাগিয়ে নিচ্ছে। ওই কর্মকর্তা জানান, এ পর্যন্ত তার চারটি শাখা থেকে শতাধিক ভালো গ্রাহক বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে ব্যাংকে চলে গেছে; কারণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কম সুদে তারা বিনিয়োগ নিতে পারছেন। এ পরিস্থিতিতে তাদের বিনিয়োগ থেকে আয় কমে গেছে; কিন্তু আয় কমলেও তাদের ব্যয় কমছে না, বরং দিন দিন বেড়েই চলছে।   অন্য এক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এলসিসহ বিনিয়োগ আয়ের পাশাপাশি আরেকটি উল্লেখযোগ্য আয় ছিল পুঁজিবাজার থেকে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসত ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যয় থেকে। কিন্তু গত ২০১০ সালের পর থেকে পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতনের কারণে এখন অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্রোকার হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক লোকসান দিচ্ছে। এখন অন্য খাতের আয় এনে এসব সহযোগী প্রতিষ্ঠান পুষতে হচ্ছে। সব মিলে তারা ধারাবাহিক খারাপ অবস্থান থেকে বের হতে পারছেন না। এতে তাদের লোকসানের পাল্লা ভারী থেকে ভারী হচ্ছে।    

No comments:

Post a Comment