Sunday, November 30, 2014

রাজধানীর ৫১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বেহাত:কালের কন্ঠ

সরকারি-বেসরকারি দখলবাজদের থাবায় অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে রাজধানীর অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কোনো কোনো বিদ্যালয় এরই মধ্
যে ঠিকানাবিহীন হয়ে পড়তে বসেছে। এ ধরনের ৫১টি বিদ্যালয়ের দখলবাজদের চিহ্নিত করেছে সংসদীয় তদন্ত কমিটি। ওই সব বিদ্যালয়ের বেশির ভাগই দখল করে ওয়াসার পাম্প ও উচ্চ বিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের জমি দখল করে বস্তি, মার্কেট, কমিউনিটি সেন্টার, এমনকি মসজিদও বানানো হয়েছে। এ বিষয়ে সংসদীয় সাবকমিটির প্রধান আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরেজমিনে তদন্তকাজ শুরু হয়েছে। সাবকমিটি দ্রুততার সঙ্গে এই কাজ করছে। কাজ শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন মূল কমিটির কাছে জমা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, অবশ্যই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা থেকে দখলবাজদের উচ্ছেদ করতে হবে। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে স্থানীয় প্রয়োজনে উচ্চ বিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। আবার সরকারি পাম্পও বসানো হয়েছে। সেগুলো কী হবে সেটা আলোচনার বিষয়। আবার কয়েকটি বিদ্যালয়ের জমি নিয়ে মামলাও চলছে। সব বিষয় পর্যালোচনা করেই এ-সংক্রান্ত সুপারিশ প্রণয়ন করা হবে। সংসদীয় কমিটির পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ঢাকার কোতোয়ালি থানার সুরিটোলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিতে ওয়াসার পাম্প বসানো হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যালয় ভবনের প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ তলা ব্যবহার করছে রমনা রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়। এফকেএম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে বংশাল উচ্চ বিদ্যালয়। আর তৃতীয় ও চতুর্থ তলা কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ছোট কাটরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দখল করে রেখেছে আবদুল হামিদ কালান্দর উচ্চ বিদ্যালয়। আরমানিটোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৮.০২ শতাংশ জমির মধ্যে ৫.৬ শতাংশ জমি নিজ নামে নামজারির মাধ্যমে দখল করেছেন সাবেক প্রধান শিক্ষক। নাজিরাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি কক্ষ নাজিরাবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় দখল করে মালপত্র রেখেছে। হাজি মাজহারুল হক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষ আনসার বাহিনী দখলে রেখেছে। গোয়ালনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি ১৯৯০ সাল থেকে স্থানীয় হাই স্কুলের নামে দখলে রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, সূত্রাপুর থানার গোণ্ডারিয়া মহিলা সমিতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৫.৭৬ শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছে স্থানীয় ‘খেলাঘর’। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের সামনে তিনটি দোকান গোণ্ডারিয়া মহিলা সমিতির দখলে রয়েছে। এমএ আলীম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ শতাংশ জমি দখল করে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করছেন স্থানীয় এক প্রভাবশালী। বাংলাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় ‘প্রতিষ্ঠাতা’ বসবাস করছেন। শ্রেণিকক্ষের মধ্য দিয়ে তাঁরা আসা-যাওয়া করেন। শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২.০৩ শতাংশ জমি দখল করেছে শহীদ নবী উচ্চ বিদ্যালয়। বিপিন রায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরের ভেতরে একটি ‘ক্লাবঘর’ বানানো হয়েছে। মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি নিয়ে আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে মামলা চলছে। ঢালকানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি নিয়েও মামলা আছে। শিশুরক্ষা সমিতি প্রাথমিক বিদ্যালয় নতুন জাতীয়করণ হলেও স্থানীয় পঞ্চায়েত কমিটি এ বিদ্যালয়ের ১৬ শতাংশ জমি দখল করে ঘর বানিয়েছে। শিশুরক্ষা সমিতি কারিগরি মহাবিদ্যালয় পরিচালনা করছে। ডেমরা থানার ব্রাহ্মণচিরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩১ শতাংশ জমিতে টিনের ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছে দখলদাররা। সংসদীয় কমিটি সূত্রে জানা যায়, আগারগাঁও তালতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দখল করে বানানো হয়েছে মসজিদ ও ক্লাবঘর। বাসাবো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিতে টিনশেডের দোতলা ঘর তুলে দোকান চালানো হচ্ছে। সেখানে স্থায়ী ভবন নির্মাণেরও প্রক্রিয়া চলছে। মিরপুর থানার কাজী ফরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৬৯ শতাংশ জমিতে বস্তি বানিয়ে অবৈধভাবে বসবাস চলছে। শেরে বাংলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৩ শতাংশ জমিতে বস্তি বানিয়ে বসবাস করছে অবৈধরা। গাবতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিতে দুটি দোকানঘর, একটি বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া পুরনো ভবনটি ট্রাক মালিক সমিতির কাছে অবৈধভাবে ভাড়া দিয়েছেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি। পল্লবী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় তলা দখল করে রেখেছে স্থানীয় হাই স্কুল। মিরপুর সেনানিবাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মূল ভবন ব্যবহার করে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয়। এতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির কাজ চালাতে হয় সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টার পর্যন্ত। মনিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮ শতাংশ জমি রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ বিদ্যালয়ের জমি নিয়ে ‘মিস কেস’ চলছে। শহীদবাগ প্রাথমিক বিদ্যালয় নতুন জাতীয়করণ হলেও প্রায় ৫ শতাংশ জমিতে পাম্প বসিয়েছে ওয়াসা। সদ্য জাতীয়করণ হওয়া আবদুল মান্নান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৬ শতাংশ জমির মধ্যে ২০ শতাংশই বেদখল হয়ে গেছে। খলিলুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পূর্ব পাশে বস্তিরা অবৈধভাবে ঘর তৈরি করে বসবাস করছে। বনফুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দখল করে আছে শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ। রমনা থানার সামাজিক শিক্ষাকেন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে দখল হয়ে আছে। এটি নিয়ে মামলা চলছে। দিলকুশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪ শতাংশ জমিতে আরামবাগ গার্লস হাই স্কুল ও দোকান বসানো হয়েছে। রমনা রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিতে গড়ে উঠেছে কাঁচাবাজার। জানা যায়, ধানমণ্ডি ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি কক্ষ ব্যবহার করছে ধানমণ্ডি ল কলেজ। ওই জমিতে ওয়াসার পাম্পও বসানো হয়েছে। মোহাম্মদপুরে শাহীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩০ শতাংশ জমিতে অবৈধভাবে ঘর বানিয়েছে কিছু লোক। কামরাঙ্গীরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৭ শতাংশ জমি দখলে নিয়েছেন জমিদাতার উত্তরাধিকারী। মাতুয়াইল ২ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিতে ওয়াসার পাম্প বসানো হয়েছে। মাতুয়াইল পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি ও মূল ভবন বেদখল হয়ে গেছে। মুরাদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিও বেদখলে। ধার্মিকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি ও পুকুর বেদখলে আছে। গুলশান থানায় মেরাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিতে পাম্প বসানো হয়েছে। মহাখালী আবদুল হামিদ দর্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি কক্ষ দখল করেছে স্থানীয় হাই স্কুল। কাচকুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিসহ ভবন দখলে নিয়েছে স্থানীয় কলেজ। দক্ষিণখান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিতে ঈদগাহ করা হয়েছে। একাংশ উত্তরা কলেজিয়েট স্কুলের দখলে আছে। সদ্য জাতীয়করণ হওয়া চালাবন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি স্থানীয় হাই স্কুল দখল করেছে। মতিঝিল থানার আইডিয়াল মুসলিম বালক/বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিতে ওয়াসার পাম্প বসানো হয়েছে। মাদারটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিতেও ওয়াসার পাম্প বসানো হয়েছে। মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দখল করেছে মতিঝিল কলোনি। টিঅ্যান্ডটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দখল করেছে টিঅ্যান্ডটি হাই স্কুল। খিলগাঁও স্টাফ কোয়ার্টার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দখল করেছে খিলগাঁও স্টাফ কোয়ার্টার হাই স্কুল। দক্ষিণ বাসাবো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দখল করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়ি বানানো হয়েছে। খিলগাঁও মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি পাশের বাড়ির গ্যারেজের জন্য দখল করা। বেইলি রোডের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি বেদখলে থাকায় শিক্ষার্থীদের খোলা আকাশের নিচে পরীক্ষা দেওয়ার খবর সম্প্রতি প্রচারিত হওয়ায় বিষয়টি আলোচনায় আসে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের আন্দোলনের মুখে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রকৃত অবস্থা চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত ২২ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি বেদখল হওয়ার বিষয়টি আলোচনা হয়। সেখানে বিদ্যালয়ের জায়গা দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি সাবকমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইনকে আহ্বায়ক করে গঠিত এই সাবকমিটিতে সদস্য রাখা হয় নজরুল ইসলাম বাবু, আলী আজম, মোহাম্মদ ইলিয়াছ ও উম্মে রাজিয়া কাজলকে। সাবকমিটি এরই মধ্যে সরেজমিনে তদন্ত শুরু করেছে। তদন্তের মাধ্যমে ৫১টি বিদ্যালয়ের দখলবাজদের চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই দখলবাজদের উচ্ছেদ করার কাজও শুরু হয়েছে।

No comments:

Post a Comment