একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা যাবে। দণ্ডিত ব্যক্তি ও রাষ্ট্রপক্ষ উভয়ই এ সুযোগ পাবে। পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে এ আবেদন করতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুনর্বিবেচনার আবেদন নিষ্পত্তি করতে হবে। জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নেতা আবদুল কাদের মোল্লার পুনর্বিবেচনার আবেদন নিষ্পত্তি করে দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সুপ
্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১ মিনিটে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। ওই দিন দুপুরে কাদের মোল্লার পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ। প্রায় এক বছর পর গতকাল মঙ্গলবার পূর্ণাঙ্গ এই রায় প্রকাশিত হয়। ৬৫ পৃষ্ঠার রায়টি লিখেছেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন প্রধান বিচারপতি ও অন্য তিন সদস্য বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। আপিল বিভাগের এ রায়ে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের জবাব মিলেছে। এ রায়ের ফলে মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনা চাইতে পারবেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। ৩ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এখন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে তিনি পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারবেন। তেমনি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের পুনর্বিবেচনা চাইতে পারবে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন আপিল বিভাগ। তবে এই রায় এখনো পূর্ণাঙ্গ আকারে বের হয়নি। গতকাল এ রায় প্রকাশের পর নিজ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘রিভিউ নিয়ে যে দোদুল্যমানতা ছিল, এই রায়ের মাধ্যমে তা দূর হয়েছে। আমরা বলেছিলাম রিভিউ চলবে না। কিন্তু আপিল বিভাগ তাঁর সিদ্ধান্ত দিয়ে বলেছেন রিভিউ চলবে। আপিল বিভাগের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা আছে, এটা দিয়ে তাঁরা রিভিউ শুনতে পারেন।’ তবে সাঈদীর দণ্ডাদেশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ পুনর্বিবেচনার আবেদন করবে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, ‘সাঈদীর পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর সেটা আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখব।’ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি প্রথম থেকেই বলছি রিভিউ চলবে। আইনে না থাকলেও দেশের সর্বোচ্চ আদালত ন্যায়বিচারের স্বার্থে রিভিউ করার অধিকারী। কামারুজ্জামানের মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করা হবে। পুনর্বিবেচনার অধিকার: রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি ছিল, সংবিধানের ৪৭(৩) ও ৪৭ক(২) অনুচ্ছেদ একসঙ্গে পড়লে দেখা যায়, যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তির সংবিধানের অধীনে প্রতিকার চাওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার অধিকার নেই। আপিল পুনর্বিবেচনার আবেদন হচ্ছে সংবিধানের অধীনে প্রতিকার চাওয়া। এ জন্য কাদের মোল্লাও এই অধিকার পাবেন না। তবে সর্বোচ্চ আদালত এ প্রসঙ্গে তাঁর রায়ে বলছেন, ৪৭ক(২) অনুচ্ছেদ গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়লে দেখা যায়, এই বিধানে কোথাও আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার অধিকার খর্ব করা হয়নি। আর আদালতের মূল কাজ হচ্ছে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। রায়ে যদি কোনো ভুল থেকে থাকে বা ত্রুটি ধরা পড়ে, তখন আদালত এই বলে চোখ বন্ধ করে রাখতে পারেন না যে সেটা শোধরানোর জন্য কোনো নির্দিষ্ট বিধান নেই। এ জন্য আদালতকে নতুন করে কোনো ক্ষমতা দেওয়ার দরকার নেই, এই ক্ষমতা আদালতের সব সময়ই আছে। কোনো আইনে যদি প্রয়োজন মেটানোর মতো সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকে, তবে আদালত ন্যায়বিচারের স্বার্থে অন্তর্নিহিত ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেন। এই ক্ষমতা আদালতকে দেওয়াই হয়েছে যেন ন্যায়বিচার করতে গিয়ে আদালত নিজেকে অসহায় মনে না করেন। আদালত রায়ে এটাও উল্লেখ করেছেন, পুনর্বিবেচনার আবেদন কখনোই আপিলের সমতুল্য নয়। ফৌজদারি বিষয়ে পুনর্বিবেচনার আবেদন তখনই গ্রহণযোগ্য, যখন মামলা বিচারে কোনো বাস্তবসম্মত ভুল হয়। আপিল শুনানির সময় দুই পক্ষ যেসব বিষয়ে ইতিমধ্যে বিস্তারিত আলোচনা করে ফেলেছে, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি পুনর্বিবেচনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আইনে কোনো ফাঁক থাকলে আদালত তা দূর করতে অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। আপিল বিভাগ রায়ে আরও বলেছেন, সর্বোচ্চ আদালত যখন কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন, তখন সেই আসামি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড মানসিক চাপে পড়েন। একজন মানুষকে অনির্দিষ্টকালের জন্য এ ধরনের অমানবিক পরিস্থিতিতে রাখা কাম্য নয়। এ জন্য যখন আসামির মৃত্যুদণ্ডের সংবাদ কারাগারে যাবে, তখনই কারা কর্তৃপক্ষের উচিত দণ্ড কার্যকরের একটি সংক্ষিপ্ত তারিখ নির্ধারণ করা এবং আসামিকে তাঁর বিশেষ অধিকারগুলো (আপিল পুনর্বিবেচনা বা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা) সম্পর্কে জানানো। পুনর্বিবেচনা ও ক্ষমার আবেদন দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তি করা উচিত। যদি আসামি এসব সুবিধা নিতে না চান, তবে কারা কর্তৃপক্ষের উচিত দেরি না করে পূর্বনির্ধারিত তারিখে দণ্ড কার্যকর করা। জেল কোডের ৯৯১ বিধি অনুসারে ৭ বা ২১ দিনে দণ্ড কার্যকরের নিয়ম এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত চারজনের ক্ষেত্রে করা আপিল নিষ্পত্তি হয়েছে। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়। কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ৩ নভেম্বর রায় দেন আপিল বিভাগ। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির নেতা আবদুল আলীমকে গত বছরের ৯ অক্টোবর আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তবে মারা যাওয়ায় ১৯ সেপ্টেম্বর তাঁর আপিল অকার্যকর বলে খারিজ করেন আপিল বিভাগ।
No comments:
Post a Comment