একটি বিদ্যুৎসাশ্রয়ী সিএফএল বাল্বের দাম ৩০০ টাকার মতো। দরিদ্র মানুষের পক্ষে এত টাকা দিয়ে একটি বাতি কেনা কঠিন। তাই তাদের
ভরসা ফিলামেন্ট বাল্ব। তাদের আরেকটু কম দরে বাতি কেনার সুযোগ করে দিতে এবারের বাজেটে ফিলামেন্ট বাল্বের ওপর ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক পুরোপুরি মওকুফ করে দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু ফল শূন্য। ঢাকার বিক্রেতারা জানিয়েছে, ওইসব বাল্বের দাম এক টাকাও কমেনি। গত জুনে ১০০ ওয়াটের একটি ফিলামেন্ট বাল্বের দাম কম্পানিভেদে ৩২-৩৬ টাকা ছিল, এখনো তা-ই আছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পণ্যে শুল্ক ও করছাড় দিয়েছে সরকার। কিছু পণ্যে শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছিল দরিদ্র মানুষ ও রোগীদের সুবিধার জন্য। ৭৭০টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক কমানো হয় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চাপে। কর ও শুল্কছাড় পাওয়ায় বাজারে এসব পণ্যের দাম কমার কথা। কিন্তু তা হয়নি। উৎপাদক ও আমদানিকারকরা শুল্কছাড়ের সুবিধা ঠিকই পায়, কিন্তু সরকার ও লক্ষিত জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হয়। এনবিআরের প্রাক্কলন অনুযায়ী, সর্বশেষ শুল্কছাড়ের ঘোষণার ফলে সরকার ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব কম পাবে। বাজেট ঘোষণার দিন কোনো পণ্যে শুল্কছাড় দেওয়া হলে ভোক্তারা খুশি হয়। সরকারও সাধুবাদ পায়। গত বাজেটে কিডনি রোগীর ডায়ালিসিসের সলিউশন (রাসায়নিক দ্রব্য), ওষুধের কাঁচামালের ওপর কর কমানো, গরিবের জন্য বৈদ্যুতিক বাতির দাম কমাতে শুল্কছাড় দেওয়ার ঘোষণা প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু রোগী ও গরিব ক্রেতারা শেষ পর্যন্ত পায়নি কিছুই। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট কার্যকর হয়েছে গত ১ জুলাই। কিন্তু বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুল্কছাড় পাওয়া পণ্যের দাম কমেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং বেড়েছে। তবে বাজেটে যেসব পণ্যের ওপর শুল্ক ও কর বাড়ানো হয়েছে সেগুলোর দাম ঠিকই বেড়েছে, তাও বাজেট কার্যকর হওয়ার আগেই। কিডনি ডায়ালিসিসের জন্য প্রয়োজনীয় সলিউশনের ওপর প্রযোজ্য মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট/মূসক) পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয় চলতি বাজেটে। কিন্তু রাজধানীর অন্তত চারটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও ডায়ালিসিস বাবদ খরচ কমেনি। রাজধানীর ফার্মগেটের আল-রাজী হাসপাতালে ডায়ালিসিসের জন্য প্রথমবার নেওয়া হয় তিন হাজার টাকা। পরের প্রতিবারের জন্য দুই হাজার ২০০ টাকা। গত দুই-তিন মাসে ডায়ালিসিসের খরচ কমানো হয়েছে কি না জানতে চাইলে হাসপাতালের একজন কর্মী জানান, খরচ আগের মতোই আছে। মগবাজারের ইনসাফ বারাকাহ কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানেও ডায়ালিসিসের খরচ কমেনি। তারা চার্জ নেয় এক হাজার টাকা। এর সঙ্গে অন্যান্য উপকরণ যোগ করে প্রতিবার দুই হাজার ৮০০ টাকা খরচ পড়ে। বাজেটে ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যাপক শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছে। অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের ৪০টি কাঁচামাল ও আয়ুর্বেদিক ওষুধের ৪১টি কাঁচামালে বিদ্যমান ১০ ও ২৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে রেয়াতি হারে ৫ শতাংশ ধার্য করা হয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসার ওষুধ তৈরিতে ১৪টি কাঁচামালের শুল্ক পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ওষুধের দোকানগুলোর বিক্রেতারা গত কয়েক মাসে দাম কমেছে এমন কোনো ওষুধের নাম বলতে পারেননি। ভিআইপি ড্রাগ হাউসের ব্যবস্থাপক মো. সাদেক বলেন, ‘পত্রিকায় কর কমার খবর পড়ে অনেক ক্রেতা এসে জানতে চান ক্যান্সারের ওষুধের দাম কমেছে কি না। কিন্তু বাংলাদেশ এমন এক দেশ, যেখানে বাজেটে কর বাড়লে দাম বাড়তে সময় লাগে না। কিন্তু কমলে দাম কমে না।’ ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহার্য সাতটি ইনজেকশনের নাম বলেন তিনি। এগুলোর দাম ৮১৫ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। একটিরও দাম কমেনি। শাহবাগের পপুলার ফার্মেসির কর্মী গোলাম কিবরিয়া বলেন, বাজেটে যেদিন ক্যান্সারের ওষুধের কর ছাড় দেওয়া হয় সেদিন থেকে ক্যান্সারের ওষুধ প্রস্তুতকারক বীকন ফার্মার শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে। কিন্তু তাদের ওষুধের দাম কমেনি। বাজেটে কাঁচামালে শুল্কছাড় দেওয়া হলেও ওষুধের দাম কমেনি কেন জানতে চাইলে বীকন ফার্মার এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট এ কে এম আনোয়ারুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যে শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছে তা খুব বেশি নয়। এর আগে থেকেই আমাদের ওষুধের দাম বিদেশি ওষুধের তুলনায় কম ছিল। ফলে ওষুধের দাম যে অনেকখানি কমবে বলে আশা করা হয়েছিল, সেটা হওয়ার সুযোগ নেই।’ ট্রাসটিউনিক্স নামের একটি ইনজেকশনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিদেশে এ ওষুধটির দাম দেড় লাখ টাকা। আমরা সেটি অনেক আগে থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করছি।’ মাস দেড়েক আগে ফিলগ্রাস্ট নামের একটি ওষুধের দাম কমেছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘এটি আমরা আগে চার হাজার টাকায় বিক্রি করতাম। এখন দুই হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি করি।’ ওষুধের কাঁচামালের দাম কমানো হয়েছিল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সুপারিশে। তারা এখন দাম কমানোর বিষয়টি কার্যকর করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না জানতে চাইলে অধিদপ্তরের পরিচালক সেলিম বারামী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ১১৭টি ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করি। অন্যান্য ওষুধের দাম নির্ধারিত হয় কম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। কাঁচামালের খরচ কমায় ওষুধের দাম কমানোর বিষয়টি নির্ভর করছে কম্পানিগুলোর ওপর।’ বাজেটে হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহার্য চার রকমের কাঁচামালের শুল্ক পুরোপুরি তুলে নিয়েছে সরকার। একটিতে ২৫ শতাংশ, দুটিতে ১০ শতাংশ করে ও আরেকটিতে ৫ শতাংশ হারে শুল্ক ছিল। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে এসব শুল্ক তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু এতে পোলট্রি খাদ্যের দামে কোনো প্রভাব পড়েনি বলে জানান পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মহসিন। মহসিন বলেন, কয়েক মাস আগেও বিভিন্ন কম্পানির পোলট্রি খাবারের দাম কেজিপ্রতি ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা ছিল। এখনো আগের দাম-ই আছে। শুল্কছাড়ের সুবিধা কম্পানিগুলো পেয়েছে; খামারিরা পায়নি। তিনি বলেন, উপকরণের খরচের চেয়ে পোলট্রি খাবারের দাম অনেক বেশি। এ কারণে অনেক ক্ষুদ্র খামার মালিক নিজেরা শস্য ভাঙিয়ে খাবার তৈরি করে মুরগিকে খাওয়ায়। তারা কম্পানির খাবার কেনে না। বাজেট ঘোষণার পর, কিন্তু কার্যকর হওয়ার আগেই বিভিন্ন ধরনের গাড়ি, সিগারেট, বাইসাইকেলের টিউব ও বাসের টায়ারসহ বেশ কিছু পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এগুলোর ওপর শুল্ক বা কর বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানোটা কার্যকর কিন্তু কমানোটা কার্যকর হয় না। ৭৭০ পণ্যের সম্পূরক শুল্ক কমানো হলেও এর প্রভাব দেখা যায়নি এখনো। ফলে বিদেশি চিপস, রেজর, টুথব্রাশ, কাপড়, প্রসাধনী, চকোলেটসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম কমেনি। শুধু এ বাজেট নয়, গত বাজেটেও শুল্কছাড় দেওয়া অনেক পণ্যের দাম কমেনি। গতবার চা আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক তুলে নেওয়া হয়েছিল। পরে আন্তর্জাতিক বাজারেও চায়ের দাম কমেছে। কিন্তু শুল্কছাড়ের সুফল ক্রেতারা পায়নি। ভোক্তা অধিকারবিষয়ক সংগঠন ভলান্টারি কনজ্যুমার অ্যাওয়ারনেস অ্যান্ড ট্রেনিং সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক খলিলুর রহমান সজল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওষুধ, পোলট্রি খাবারের কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্যে শুল্কছাড় দেওয়া সরকারের একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত। কিন্তু এর সুফল সাধারণ মানুষ পায়নি। কারণ, সরকারের এ বিষয়ে কোনো তদারকি নেই।’ ব্যবসায়ীদের নীতিবোধের অভাব ও শক্তিশালী ভোক্তা অধিকার আন্দোলন না থাকাও এর কারণ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
No comments:
Post a Comment