Sunday, November 9, 2014

ভারমুক্ত বনাম ভারযুক্ত:কালের কন্ঠ

দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় দুই নেতা- একজন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আরে
কজন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সরকারি দল পরিচালনা আর সরকারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনায় এই দুজনের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে দলে দুই নেতার হালহকিকত। জানা গেছে, হিংসুক-নিন্দুকদের খোঁচার মুখেও প্রজ্ঞা, মেধা ও সততার জোরে অটুট আছেন সৈয়দ আশরাফ। কিন্তু ভালো নেই মির্জা ফখরুল। অনেক গুণের আলো নিয়েও দলীয় নেতৃত্বের ঘোরপ্যাঁচে পড়ে জীবনে আজ তাঁর অন্ধকার দশা   ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হয়েই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমন সক্রিয় হয়ে ওঠেন যে দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে কারামুক্ত করা ও দলকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাই বেশি আলোচিত হয়। সেটি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের কথা। এর আগে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে থাকলেও কাজ করার তেমন সুযোগ হয়ে ওঠেনি তাঁর। এরপর ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই দলের জাতীয় সম্মেলনে ‘ভারমুক্ত’ হয়ে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। পরের বার ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সম্মেলনে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা আবারও তাঁকে বেছে নেন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এবং আবারও দলকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখেন তিনি। কোনো দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এ দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। এত কিছুর পরও সৈয়দ আশরাফের বিরুদ্ধে দলের কিছু নেতা-কর্মীর অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। তবে অভিযোগগুলো খুবই ‘মাজুল’ ধরনের বলে জানা যায়। যেমন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো- তিনি অলস, ঘুমকাতুরে। এ অভিযোগের ব্যাপারে অনুসন্ধানে জানা যায়, সৈয়দ আশরাফ ঘুম থেকে ওঠেন খুব ভোরে। সকাল ৬টা থেকে ১০টার মধ্যে ইন্টারনেটে বিশ্বভ্রমণ করেন তিনি। সারা বিশ্বের খোঁজখবর নিয়েই দিনের কাজ শুরু করেন। দেশি-বিদেশি সব সংবাদমাধ্যম আশরাফের দৃষ্টি এড়ায় না বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়। ওই সূত্রের দাবি, ‘ধান্দাবাজ’ নেতা-কর্মীরা ফোন করে সৈয়দ আশরাফকে খুঁজলে তাঁর এপিএস, পিএস ও অন্যান্য কর্মকর্তা প্রায়ই নেতাকে বিরক্তির হাত থেকে বাঁচাতে ‘তিনি এখন ঘুমে’ জানানোয় সবার কাছে ছড়িয়ে গেছে ওই অভিযোগ।   সৈয়দ আশরাফের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ- নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দেখা না করা, নিজেকে গুটিয়ে রাখা, দলীয় কার্যালয়ে যাতায়াত না করা, মিডিয়ায় অনুপস্থিতি ইত্যাদি। এসব মিলিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তোলা হয় জোরালোভাবে। দলের একটি অংশ সুযোগ পেলেই সৈয়দ আশরাফকে ঘায়েল করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তবে এসব অভিযোগের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়াহীন আশরাফকে ঘায়েল করা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে এখনো অদ্বিতীয় সৈয়দ আশরাফ। রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা, মেধা-মনন এবং সর্বোপরি সততা সৈয়দ আশরাফকে শেখ হাসিনার কাছে বিকল্পহীন করে তুলেছে। সৈয়দ আশরাফ সম্পর্কে বলতে গিয়ে দলের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তাঁর সঙ্গে অনেক নেতা-কর্মীর সহজে দেখা মেলে না, এ অভিযোগ সত্য। এর সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই। তবে প্রশ্ন হলো- তারা কারা? তদবিরবাজ, ধান্দাবাজ এরা। তা ছাড়া সৈয়দ আশরাফ আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও সততার প্রশ্নেও তিনি অদ্বিতীয়।’ সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য আশরাফ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ- তিনি কারো ক্ষতি করেন না। দৌড়ঝাঁপ হয়তো করেন না; কিন্তু চুপচাপ থেকেই দেশের জন্য, জনগণের জন্য কাজ করে যান তিনি। এই নেতা বলেন, আশরাফের যারা সমালোচনা করে তারা যদি কেউ সৎ, নিষ্ঠাবান ও উচ্চমনা হতো, তাহলে সেটি সমর্থন করা যেত। কিন্তু যারা সমালোচনা করে আশরাফের, তারা সবাই ‘বদের হাড্ডি’। সূত্র মতে, আর এ কারণেই শক্ত প্রতিপক্ষ থাকলেও আশরাফের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব হয় না দলের অনেক বাঘা বাঘা কেন্দ্রীয় নেতার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সভাপতিমণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য, একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সম্পাদকমণ্ডলীর কয়েকজন নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ঘায়েল করার জন্য ছিদ্র অন্বেষণ করেই চলেছেন। তাঁরা কখনো কখনো বিশেষ সম্মেলন করে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁকে বাদ দিতেও প্রস্তাব করেছেন। সর্বশেষ চার সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবির পর এর জন্য সৈয়দ আশরাফকে দায়ী করে ওই মহলটি তাঁকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়। কিন্তু সৈয়দ আশরাফের প্রতি শেখ হাসিনার আস্থা-বিশ্বাসের জায়গায় ফাটল ধরানো সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ও দলের বেশ কিছু নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হেসে উঠে বলেন, ‘এ বিষয়ে কী বলব? সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যতটুকু দায়িত্ব পালন করার, তা তো করছিই।’ প্রতিপক্ষ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে এগুলো থাকবেই। মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হবে।’ তিনি বলেন, রাজনীতি কেবল মাঠে-ময়দানেই নয়, রাজনীতির অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। রাজনীতি করার জায়গাটিও অনেক প্রশস্ত। তিনি আরো বলেন, ‘দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সব দায়িত্ব কুক্ষিগত করার পক্ষেও আমি নই। রাজনীতি মানে একটি টিম ওয়ার্ক। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, সৈয়দ আশরাফের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও মেধার ভূয়সী প্রশংসা করেন শেখ হাসিনা নিজেই। আস্থা-বিশ্বাসের জায়গায়ও আশরাফের বিকল্প দ্বিতীয়টি নেই শেখ হাসিনার কাছে। দলীয় সভাপতির কাছে সৈয়দ আশরাফের এ অবস্থানের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণও রয়েছে। সূত্র মতে, তার মধ্যে প্রধান তিনটি হলো- গত বছরের ৫ মে হেফাজতে ইসলামকে ঢাকা থেকে উচ্ছেদ, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাঁর রণকৌশল ও কর্মতৎপরতা আর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দলের ও সরকারের হয়ে তাঁর ইতিবাচক ভূমিকা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হেফাজতে ইসলামকে ঢাকা থেকে হটানোর ক্ষেত্রে সৈয়দ আশরাফের অবদান ছিল জাদুকরের মতো। একদিকে সেদিন সংবাদ সম্মেলন করে প্রশাসনকে শক্তি জুগিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করে তাঁর সংবাদ সম্মেলন। জানা যায়, শেখ হাসিনা নিজেও ওই দিনের সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া সৈয়দ আশরাফের হুমকির পর বলেন, "তাদেরকে আরো ‘সফটলি হ্যান্ডল’ করা যেত না আশরাফ?" জবাবে সৈয়দ আশরাফ বলেন, ‘ওদেরকে ছাড় দেওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই।’ পরে শেখ হাসিনা সেদিনের জন্য আশরাফের ওপরই ভরসা করেন। আর তাতে সফলও হন তিনি। এরপর ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন সফল করতে শেখ হাসিনা ও আশরাফের রণকৌশলই ছিল প্রধান। আওয়ামী লীগের অনেক নেতার মতে, নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে দুই শীর্ষ নেতার কৌশলে। এ রকম অসংখ্য ঘটনা সৈয়দ আশরাফ তাঁর প্রজ্ঞা ও মেধা দিয়ে উতরেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রেও সফলতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে জাতিসংঘের দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে সৈয়দ আশরাফ শতভাগ সফলতার পরিচয় দিয়েছেন বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।    আশরাফ সম্পর্কে শেখ হাসিনার উঁচু ধারণা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরেকটি সূত্র জানায়, গত বছর গণভবনে দলের তৃণমূলের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জানা গেছে, সভা শেখ হাসিনার বক্তব্য দিয়ে শেষ করার কথা। এর আগে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ আশরাফ উপস্থিত নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে প্রায় আধাঘণ্টার একটি বক্তব্য দেন। এরপর শেখ হাসিনার পালা আসে। কিন্তু তিনি আর কোনো বক্তব্য না দিয়ে বলেন, ‘এ সভায় আশরাফ যে বক্তৃতা দিয়েছে তার পরে আমার আর কোনো কথা নাই।’ এর পরই ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে সৈয়দ আশরাফের প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, আশরাফের মতো মেধাবী একজন নেতাকে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছে না আওয়ামী লীগ। অন্য একটি সূত্র জানায়, দলে শেখ হাসিনার আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে সমর্থ হয়েছেন বলেই আশরাফের শত্রু থাকলেও বড় সমস্যার মুখোমুখি পড়তে হয় না তাঁকে। আশরাফের সততা নিয়ে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, তিনি মন্ত্রী হয়েছেন টানা দুইবার; কিন্তু এখনো লাল পাসপোর্ট নেননি। ব্যক্তিগত কোনো গাড়িও নেননি। প্রায় সব এমপি শুল্কমুক্ত গাড়ি নেওয়ার সুযোগ গ্রহণ করলেও আশরাফ এর ব্যতিক্রম।  ইদানীং সৈয়দ আশরাফের বিরুদ্ধে ওঠা নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগও ভুলতে বসেছে নেতা-কর্মীরা। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সৈয়দ আশরাফ এখন সংগঠনের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। দলীয় কার্যালয়ে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি যাতায়াত করছেন। সচিবালয়ের দপ্তরেও তাঁর উপস্থিতি বেড়েছে। জানা যায়, তাঁর দপ্তরে কোনো ফাইল পড়ে থাকে না। প্রয়োজনে অসম্পূর্ণ ফাইল তিনি বাসায় নিয়ে গিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করেন। গত ঈদের পর তাঁর চলাফেরা অনেক বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। নির্ধারিত-অনির্ধারিতভাবে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন ধানমণ্ডির কার্যালয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ চলছে চোখে পড়ার মতো। দলীয় সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কড়া নির্দেশে ডিসেম্বরের মধ্যে জেলা সম্মেলন শেষ করতে কোমর বেঁধেছেন সৈয়দ আশরাফ। ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত ঠাকুরগাঁও জেলা সম্মেলনে তিনি প্রধান অতিথি ছিলেন। আজ ৯ নভেম্বর জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের উদ্বোধক থাকার কথা সৈয়দ আশরাফের। এ ছাড়া ঢাকা, খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম বিভাগের বেশ কয়েকটি জেলা সম্মেলনে তিনি যোগ দেবেন বলে দলের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে। এখন তিনি নিয়মিত আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়েও বসবেন বলে দলের দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।   ভালো নেই মির্জা ফখরুল বিশেষ প্রতিনিধি ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তিতে নেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে কার্যত মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করলেও এখনো তিনি ‘ভারমুক্ত’ (পূর্ণ মহাসচিব) হতে পারেননি। অনেকের মতে, মূলত লন্ডনপ্রবাসী দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মন জুগিয়ে চলতে না পারাই এর নেপথ্য কারণ। এ ছাড়া তৃণমূলে ব্যাপক সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি হলেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাঁর বিরোধিতাকারীর সংখ্যাই বেশি। পাশাপাশি দলে ‘ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র’ বলে পরিচিত গুলশান কার্যালয়ের প্রভাবশালী দু-একজন কর্মকর্তাও তাঁর বিপক্ষে।  ওদিকে অপেক্ষাকৃত ‘উদারপন্থী’ নেতা হওয়া সত্ত্বেও সরকারবিরোধী কড়া বক্তব্যের কারণে সরকারেরও রোষানলে মির্জা ফখরুল। তাঁর বিরুদ্ধে মোট মামলার সংখ্যা ৫৪। এর মধ্যে ২৪টিতে চার্জশিট হয়েছে। ব্যবসা এবং সম্পদ রক্ষার কৌশলগত কারণে বিএনপির প্রভাবশালী দু-একজন নেতার সঙ্গে সরকারের গোপন ‘সখ্যের’ কথা শোনা গেলেও ফখরুলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নেই। অথচ দীর্ঘ সময় ‘ভারপ্রাপ্ত’ মহাসচিব থাকার কারণে সরকারি দলের নেতারাও তাঁকে ‘টিজ’ করতে ছাড়ছেন না। এ রকম এক পরিস্থিতির মধ্যেই ইদানীং ফখরুলের দু-একটি কাজে কিছুটা ‘বিরক্তি’ প্রকাশ করছেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সব মিলিয়ে ভালো নেই মির্জা ফখরুল। অবশ্য জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল কালের কণ্ঠের কাছে দাবি করেন, কোনো খারাপ অবস্থার কথা তাঁর জানা নেই। তারেক রহমান ও চেয়ারপারসন উভয়ের সঙ্গেই তাঁর সুসম্পর্ক রয়েছে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ীই কাজ চলছে। কোথাও দূরত্ব বা ভুল বোঝাবুঝি নেই। এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, ‘আমি জোর বা তদবির করে এই পদে আসিনি। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব না চাইলে থাকবও না। দলের জন্য যা মঙ্গলজনক সেটাই হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’ অবশ্য গুলশান কার্যালয়ে যাতায়াত আছে বিএনপির এমন মধ্যম ও শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ নেতারই মত, কোনো দিক থেকে ভালো নেই মির্জা ফখরুল। দলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তীব্র বিরোধিতার কারণে তিনি কোনো কাজই করতে পারছেন না। বেশ কিছু নেতা তাঁর বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার ‘কান ভারী’ করছেন বলে জানা গেছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানের মতে, ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তিতে নেই মির্জা ফখরুল। তাঁর মতে, এখন যেভাবে চলছে এভাবে চলতে থাকলে মহাসচিব পদে থাকা না থাকা তাঁর সমান কথা। দলে ফখরুলবিরোধীদের এখন জয়জয়কার বলেও মনে করেন মাহবুবুর রহমান। তাঁর মতে, ঢাকা (খালেদা জিয়া) কিংবা লন্ডন কোনোটারই সিগন্যাল ইতিবাচক বলে তো মনে হচ্ছে না। ইতিবাচক হলে তিনি সাড়ে তিন বছরে ভারমুক্ত হলেন না কেন? খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর ২০১১ সালের মার্চে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পান মির্জা ফখরুল। এরপর থেকে দলের মুখপাত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি সুধীসমাজে তিনি জনপ্রিয় হয়ে হয়ে ওঠেন। দলের মাঠ পর্যায়েও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। অনেকের মতে, দুঃসময়ে বিএনপির ইমেজ তৈরিতেও জোরালো ভূমিকা পালন করেন ‘ক্লিন ইমেজে’র অধিকারী মির্জা ফখরুল। আর এ কারণেই ঢাকার কূটনীতিকদের কাছেও তিনি অত্যন্ত পছন্দের ব্যক্তি। বিএনপির সূত্রগুলোর মতে, মূলত এসব কারণেই মির্জা ফখরুলকে এখনো ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব পদে বহাল রাখা হয়েছে। সূত্র জানায়, ফখরুল-বিরোধীদের প্রশ্নের মুখে খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশি-বিদেশি কূটনীতিক ও সুধীসমাজের পছন্দের কারণে তাঁকে বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া মহাসচিব করার মতো সব দিক থেকে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিও এ মুহূর্তে বিএনপিতে নেই বলে মনে করা হয়। তবে একান্তই তিনি এ পদে না থাকলে দলের কেউ কেউ স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামকে ফখরুলের বিকল্প হিসেবে ভাবেন। অবশ্য স্বাস্থ্যগত কারণে তরিকুল নিজেই ওই পদে যেতে রাজি নন।  লন্ডন ও গুলশান কার্যালয়ের অবস্থান পরিবর্তন? : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায়ই মূলত মির্জা ফখরুল বিএনপির কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে উঠে এসেছেন বলে ব্যাপক আলোচনা আছে। তারেকের ইচ্ছায় ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দলের জাতীয় কাউন্সিলের পর গঠিত কমিটিতে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদ লাভ করেন মির্জা ফখরুল। দলের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী এ পদটি পরবর্তী মহাসচিব হিসেবে বিবেচিত। ফলে ওই সময় দলের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং তাঁর অনুসারীরা প্রথম থেকেই ফখরুলের বিরোধিতা শুরু করেন। অনেকের মতে, এ অংশের নেতারাই বিভিন্ন সময় তারেক রহমানের কান ভারী করছেন। পাশাপাশি আগের ‘হাওয়া ভবনে’র কয়েকজন কর্মকর্তাসহ তারেকের নিজম্ব কিছু অনুসারী এখন ঢাকায় আছেন। তাঁরাও কমিটিতে পছন্দের পদসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালান। সূত্র মতে, চেয়ারপারসনের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেন ফখরুল। খালেদা জিয়ার নির্দেশেই ২৯ ডিসেম্বরের কর্মসূচির আগে আত্মগোপনে যান তিনি। অথচ এ ঘটনায় দেশের ভেতরে ও বাইরে তাঁর নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তারেক রহমান নিজেও এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ফলে তারেক রহমানের চাওয়া এবং খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্ত সব সময় এক হয় না। এতে ক্ষুব্ধ হন তারেক অনুসারীরা। ফলে তাঁরাও তারেকের কাছে নানা অভিযোগ নিয়ে যান। সূত্র জানায়, বিএনপির ভেতরে ও বাইরে এ ধরনের নানা আলোচনা ও গুঞ্জনের পর মির্জা ফখরুলও সময় পেলে লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু তারেক কখনোই এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেন না। একটি সূত্র মতে, কয়েক মাস আগে লন্ডনে গিয়ে মির্জা ফখরুল তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। বলেন, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দীর্ঘদিন থাকায় তাঁকে নিয়ে অনেক ধরনের কথা হচ্ছে। অসুবিধা হলে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হোক। জবাবে তারেক রহমান বলেন, না, তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো চিন্তা দলের মধ্যে নেই। কিন্তু বিএনপি নেতাদের মতে, তারেক রহমানের ওই আশ্বাসের কোনো মূল্য নেই। কারণ তাঁর মনোভাব ইতিবাচক হলে এত দিনে ফখরুল ভারমুক্ত হতেন। এক সময় তারেক রহমানের সমর্থনের পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে ক্ষমতাবান নেতারাও ফখরুলের পাশে ছিলেন। ২০০৯ সালের কাউন্সিলের পর খোন্দকার দেলোয়ার মহাসচিব পদে বহাল থাকলেও ওই নেতারা দ্রুত তাঁর জায়গায় মির্জা ফখরুলকে মহাসচিব করার জন্য তৎপরতা চালান। কিন্তু ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধার ও হিসাব-নিকাশে গত সাড়ে তিন বছরে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। গুলশানের দু-একজন নেতার এখন বিরাগভাজনে পরিণত হয়েছেন ফখরুল। একটি সূত্রের দাবি, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবিহউদ্দিন আহমেদ এবং আবদুল কাইউমের সঙ্গে অত্যন্ত সুসম্পর্ক মির্জা ফখরুলের। এ দুজন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় তাঁদের বিরোধীরা স্বাভাবিকভাবেই ফখরুলবিরোধী হয়ে উঠেছেন। ফলে তাঁরা চাইছেন না ফখরুল ভারমুক্ত হোন। অবস্থা ভালো নয় দলেও : মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও দলের মধ্যে মির্জা ফখরুল এই মুহূর্তে অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে একমাত্র ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাঁর পক্ষে। এর বাইরে সক্রিয় নেতাদের মধ্যে পক্ষে ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি চলে গেছে তাঁর বিরোধী বলে পরিচিত মির্জা আব্বাসের হাতে। আব্বাস ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব বরকতউল্লাহ বুলু, সমাজকল্যাণ সম্পাদক আবুল খায়ের ভূঁইয়া, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ বড় একটি অংশ প্রায় চার বছর ধরে ফখরুলের বিরোধিতা করে আসছে। সূত্র মতে, সাদেক হোসেন খোকা অসুস্থ হওয়ার পর দলের এ অংশের ক্ষমতা আরো সুসংহত হয়েছে। এদিকে স্থায়ী কমিটির বাদ বাকি সদস্যদের মধ্যে বয়সের কারণে অসুস্থ ড. আর এ গনি, এম শামসুল ইসলাম ও এম কে আনোয়ার আগে থেকেই কোনো গ্রুপিংয়ের সঙ্গে জড়িত নন। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কারাগারে। ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াও কারো পক্ষে-বিপক্ষে সক্রিয় নন। খুলনা ও যশোর অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ে বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকছেন তরিকুল ইসলাম। অন্যদিকে মির্জা ফখরুলের এই অস্বস্তির সুযোগে যুগ্ম মহাসচিবদের কারো কারো মধ্যে আবার মহাসচিব হওয়ায় উচ্চাভিলাস তৈরি হয়েছে। ফলে তাঁদের দু-একজনও ফখরুলবিরোধী গ্রুপে যোগ দিয়েছেন। তৈরি হয়নি সমর্থকগোষ্ঠী : গত ৩৬ বছরে দায়িত্ব পাওয়া প্রায় সব মহাসচিবই দলে নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের অনুসারী তৈরি করেছেন। সর্বশেষ প্রয়াত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের অনুসারীরা (ফখরুলবিরোধী বলে পরিচিত) মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে এখনো দলে প্রভাবশালী। এর আগে নীতিগত কারণে তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার পাশে ছিলেন অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, এম. সাইফুর রহমান, অলি আহমদ, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, তরিকুল ইসলাম, আবদুল্লাহ আল নোমান ও সাদেক হোসেন খোকার মতো নেতারা। এ ছাড়া অঙ্গসংগঠনের অধিকাংশ নেতাও ছিলেন তাঁর সমর্থক। ফলে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও মহাসচিব পদ থেকে সরানো যায়নি মান্নান ভূঁইয়াকে। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হওয়ার পর নানা বাধায় কখনোই স্বস্তিতে কাজ করতে পারেননি মির্জা ফখরুল। তাঁর পছন্দের লোকদের তিনি পদায়নের সুযোগও পাননি। আদর্শগত বিরোধিতা? : এদিকে রাজনৈতিক ও আদর্শগত কারণেও দলের ভেতরে ও বাইরে ফখরুলের ‘বিরোধী’ একটি বলয় তৈরি হয়েছে। সূত্র জানায়, কট্টর ডানপন্থীদের চেয়ে বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতা ও সুধীসমাজের সঙ্গে ফখরুলের বেশি সখ্য গড়ে উঠেছে। এ কারণে অলি আহমদ, বি. চৌধুরী, আ স ম রব, কাদের সিদ্দিকী ও মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ প্রগতিশীল দলগুলোকে বিএনপির কাছে টানার পক্ষে ফখরুল। কিন্তু এজন্য আবার জামায়াত ও হেফাজতসহ কট্টরপন্থী ইসলামী দলগুলো তাঁর বিপক্ষে। আবার দলের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, ফখরুল যতটা না নিজ দলের সমস্যা নিয়ে চিন্তিত তার চেয়ে বেশি ২০ দলীয় জোট নিয়ে তৎপর। এ ছাড়া বিশ্বরাজনীতির বাস্তবতায় ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বিএনপি নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ চলছে। সূত্র মতে, এ প্রশ্নে ফখরুলসহ দলের একাংশ ভারতকে বাদ দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করে। অপর অংশের মতে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত লাভ হবে না। তার চেয়ে ধর্মপ্রাণ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পক্ষপাতী তারা। সূত্র মতে, আদর্শ ও কৌশলগত এসব প্রশ্নে বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও মির্জা ফখরুলকে সমর্থনের প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত। এ কারণে সুযোগ পেলেই কেউ কেউ খালেদা জিয়ার কাছে ফখরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে ছাড়েন না।

No comments:

Post a Comment