Wednesday, November 26, 2014

২০০ কলেজশিক্ষকের ঘুষের টাকা জলে:কালের কন্ঠ

শিক্ষা ক্যাডারে সর্বোচ্চসংখ্যক পদোন্নতি হয়েছে সম্প্রতি। দুই ধাপে দুই হাজার ৫৫ জন কলেজশিক্ষককে পদোন্নতি দিয়ে মন্ত্রণাল
য় প্রশংসা কুড়ালেও পদায়ন-বাণিজ্য নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর। অভিযোগ উঠেছে, এই পদোন্নতির সুবাদে পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকদের পদায়ন করতে গিয়ে বাণিজ্যে নেমেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের সম্মিলিত সিন্ডিকেট। কিন্তু বিপুলসংখ্যক শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা নিয়েও সবাইকে পছন্দমতো পোস্টিং দিতে পারেনি তারা। পছন্দের কলেজে যাঁদের পোস্টিং দেওয়া হয়েছে তাঁদেরও বেশির ভাগই মিস পোস্টিং বা ভুল পদায়নের শিকার হয়েছেন। এক পদের বিপরীতে একাধিক শিক্ষককে পদায়ন করা হয়েছে। এভাবে টাকা দিয়েও ভুল পদায়নের শিকার হয়েছেন দুই শতাধিক শিক্ষক। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৫০ জন পদোন্নতিপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৫০ জন সহকারী অধ্যাপক। ভুল পদায়নের শিকার বেশির ভাগ শিক্ষকই এখন আগের কলেজেও থাকতে পারছেন না আবার নতুন কলেজেও যোগ দিতে পারছেন না। সেই সুযোগে আবারও বাণিজ্য করতে চাইছে ওই সিন্ডিকেট। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পদোন্নতি দেওয়ার আগে থেকে ওত পেতে ছিল ওই সিন্ডিকেট। তারা শিক্ষকদের সঙ্গে আগে থেকেই যোগাযোগ করে। আবার শিক্ষকরাও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রফা করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই সিন্ডিকেটে রয়েছেন একজন অতিরিক্ত সচিব, একজন যুগ্ম সচিব ও আরো কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আর মাউশির সিন্ডিকেটে রয়েছেন একজন উপপরিচালক, দুজন সহকারী পরিচালকসহ একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এঁদের মধ্যে মাউশির উচ্চপর্যায়ের ঘনিষ্ঠ এক কর্মকর্তাও রয়েছেন। এ ছাড়া বিসিএস শিক্ষা সমিতির সাবেক কয়েকজন নেতাও এই পদায়ন বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। এই চক্র এক থেকে দুই লাখ টাকার বিনিময়ে একজন শিক্ষককে তাঁর পছন্দের কলেজে পদায়ন দেয়। দুই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রায় ৩৫০ শিক্ষককে পদায়ন দেওয়া হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু সবার পছন্দ রাজধানী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের কলেজ হওয়ায় পদ না থাকা সত্ত্বেও যাঁদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে তাঁদের খুশি করতেই পদায়ন করা হয়েছে। পরে শিক্ষকরা যোগদান করতে গিয়ে দেখেন ওই কলেজে পদ নেই, অথবা এক পদে দুজনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এভাবে দুই শতাধিক শিক্ষক ‘মিস পোস্টিং’-এর শিকার হয়েছেন। জানা যায়, দুটি সিন্ডিকেট শুরু থেকে সব কাজ গোপনে করলেও মিস পোস্টিংয়ের কারণেই পদায়ন বাণিজ্যের ঘটনা প্রকাশ পেয়ে যায়। অনেক শিক্ষকই গোপনে টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। নাম প্রকাশ করলে তাঁদের চাকরি নিয়েই টানাটানি শুরু হবে বলে তাঁরা জানান। চট্টগ্রামের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি সহকারী থেকে সহযোগী অধ্যাপক হয়েছি। আমার পরিবারও চট্টগ্রামে থাকে। তাই শহরের একটি কলেজে পদায়নের জন্য একটি মাধ্যমে মাউশির একটি সিন্ডিকেটকে দুই লাখ টাকা দিয়েছি। কিন্তু আমাকে চট্টগ্রামের মধ্যে রাখলেও একটি উপজেলার কলেজে দিয়েছে, যাতে আমি সন্তুষ্ট নই।’ মাউশির কলেজ শাখার প্রধান ওই বিভাগের পরিচালক। তাঁর হাত দিয়েই পদায়ন হওয়ার নিয়ম। অথচ এবার তাঁকে পাশ কাটিয়েই বড় আকারের এই পদায়ন দেওয়া হয়েছে। পদায়ন-বাণিজ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর মো. আতাউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাকে এবার পদায়নের কোনো কাজে রাখা হয়নি। আমাকে পুরো অন্ধকারে রাখা হয়েছে। তাই আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।’ সরকারি কলেজের শিক্ষকদের সব বিষয় দেখভাল করে মাউশির এই কলেজ শাখা। কোন কলেজে কত পদ খালি তার যথাযথ হিসাব সংরক্ষণ করেন এই শাখার কর্মকর্তারা। তাঁদের হাত দিয়েই বদলি ও পদায়ন হয়। যদিও এবার পদায়নের কাজটি মন্ত্রণালয় করেছে। তবু কোন কলেজে কোন পদ শূন্য রয়েছে সে তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে মাউশির কলেজ শাখাই। কাকে কোন কলেজে দিলে ভালো হবে সে পরামর্শও তারাই দিয়েছে। তবে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মাউশি থেকে মন্ত্রণালয়ে যে শূন্য পদের তালিকা সরবরাহ করা হয়েছে সে অনুযায়ী পদায়ন দিলে আট থেকে দশটি ক্ষেত্রে ভুল হতে পারত। কিন্তু দুই শতাধিক শিক্ষকের ভুল পদায়ন অনিচ্ছাকৃত হতে পারে না। এর পেছনে অবশ্যই উদ্দেশ্য আছে। মন্ত্রী ও সচিব পদোন্নতি-পদায়নে মূল ভূমিকা রাখলেও কাকে কোথায় পদায়ন করা হবে তা নিয়ে তাঁদের পক্ষে মাথা ঘামানো সম্ভব নয়। মাউশির একটি গ্রুপ ও মন্ত্রণালয়ের একটি গ্রুপ তাদের ইচ্ছানুসারে এই পদায়ন দিয়েছে।’ মাউশির সহকারী পরিচালক (কলেজ-১) মোহাম্মদ তাজিব উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবার সম্পূর্ণ পদায়ন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। আমরা মন্ত্রণালয়ে শূন্য পদের তালিকা দিয়েছি। মন্ত্রণালয় যেসব বিষয়ে সহযোগিতা চেয়েছে সেসব বিষয়ে সহযোগিতা করেছি। তবে কেন এত ভুল হলো তা বলতে পারব না।’ সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুল পদায়ন দেওয়া হয়েছে। যেহেতু টাকা নেওয়া হয়েছে তাই পদ থাক বা না থাক পছন্দের কলেজে পদায়ন দেওয়া হয়েছে। এখন আবার ওই সব কলেজ থেকে আশপাশের কোনো কলেজে বা পছন্দের অন্য কলেজে পদায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছে ওই সিন্ডিকেট। এরই মধ্যে মিস পোস্টিং হওয়া ১২২ জন সহকারী অধ্যাপকের নতুন পদায়ন চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। মিস পোস্টিং হওয়া সহযোগী অধ্যাপকের তালিকায় এখনও হাত দেওয়া হয়নি। এর বাইরেও আরো অনেক শিক্ষকের মিস পোস্টিং হয়েছে, যাঁদের তালিকা এখনো মন্ত্রণালয়ে পৌঁছায়নি। সব মিলিয়ে মিস পোস্টিং হওয়া শিক্ষকের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিতুমীর কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক কুদ্দুস শিকদার এবার সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন। তাঁকে পদায়ন করা হয়েছে মৌলভীবাজার সরকারি মহিলা কলেজে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাকে যেখানে দেওয়া হয়েছে সেখানে এখনো ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপকের পদই সৃষ্টি হয়নি। ফলে আমি অধ্যক্ষের কাছ থেকে এ-সংক্রান্ত চিঠি এনে সচিব বরাবর আবেদন করেছি। পরবর্তী পদায়ন না পাওয়া পর্যন্ত এখন আমাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’ ঢাকা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের রোকেয়া পারভীন জুঁই ও এস এম মাহবুবুল ইসলাম সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। দুজনকেই পদায়ন করা হয়েছে মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজে। দুজনই যোগদান করতে গিয়ে দেখেন সেখানে পদ রয়েছে একটি। ফলে এখনো কেউ যোগদান করতে পারেননি। রোকেয়া পারভীন বলেন, ‘এক পদে দুজনকে পদায়ন করায় আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। এখন অপেক্ষা করছি আবার কোথায় পদায়ন দেয়।’ জানা গেছে, এই দুজনই মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজে থাকতে চান। একজনের জন্য সুপারিশ করেছেন এক মন্ত্রী। আর অন্যজনের বিষয়ে সুপারিশ করেছেন এক প্রতিমন্ত্রী। জানা যায়, শিক্ষকদের একটি অংশ সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদায়ন নিয়ে অনিয়মের অভিযোগসহ একটি তালিকা জমা দেয়। এতে বলা হয়েছে, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে কর্মরত ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের একযোগে ঢাকার বাইরে বদলি ও পদায়ন করা হয়েছে। মাউশির সহকারী পরিচালক এস এম কামাল হায়দার সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেলেও তাঁকে বদলি করা হয়নি। তিনি মাউশির সহকারী পরিচালক (কলেজ-২) পদেই বহাল আছেন। সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়া সত্ত্বেও একই অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (কলেজ-১) পদে বহাল রাখা হয়েছে মোহাম্মদ তাজিব উদ্দিনকে। এ দুজন দেড় বছর ধরে মাউশিতেই কর্মরত রয়েছেন। অথচ পদোন্নতি পাওয়া রাজধানীর বেশির ভাগ শিক্ষককেই বাইরে বদলি করা হয়েছে। মাউশির সেসিপ প্রকল্পে কর্মরত ড. মোরশীদুল হাসানের বিষয়ে তালিকায় বলা হয়েছে, তিনি পদোন্নতি পেলেও তাঁকে বদলি করা হয়নি। পদোন্নতির পরও মোহাম্মদ সলিম উল্লাহকে বদলি হতে হয়নি কর্মস্থল ব্যানবেইস থেকে। অথচ গুরুতর অসুস্থতার কারণে পদোন্নতি পাওয়ার মাত্র তিন দিন আগে তিতুমীর কলেজে বদলি হয়ে আসা একজন শিক্ষককেও আবার বদলি করা হয়েছে। প্রথানুযায়ী পদোন্নতি পেলে শিক্ষকদের বদলি করা হয়। ভুল পদায়নের শিকার ও দূরের কলেজে বদলি হওয়া ৬৮ জন শিক্ষক গত ১৬ নভেম্বর বৈঠক করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে। যদিও তাঁরা ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ ও প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তাকে থাকতে দেওয়া হয়নি। তবে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম বাবু এমপি, হুইপ ইকবালুর রহিম, লিয়াকত শিকদার ও পংকজ দেবনাথ উপস্থিত ছিলেন। সেই সভা শেষে শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘পদায়ন নিয়ে বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অনিয়মের অভিযোগ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনেছি। আমি তাঁদের আশ্বাস দিয়েছি, অবশ্যই তাঁদের সবার বদলির বিষয় বিবেচনা করা হবে।’ মন্ত্রী আরো বলেছিলেন, ‘শিক্ষকরা জানিয়েছেন, তাঁরা এই পদায়নের বিষয়ে আরো সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ দেবেন আমাকে। আশা করছি এই সমস্যা খুব দ্রুতই মিটে যাবে।’ শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ৮ নভেম্বর শিক্ষা ক্যাডারে এক হাজার ৬৮৮ জন শিক্ষককে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতির পর তাঁদের নতুন করে পদায়নের আদেশ জারি করা হয় ১৩ নভেম্বর। এর আগে ১৩ অক্টোবর রাতে ৩৬৭ জন সহযোগী অধ্যাপককে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। দেশের ৩০৬টি সরকারি কলেজ এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ক্যাডারের মোট পদ রয়েছে ১৫ হাজার ১১২টি।

No comments:

Post a Comment