প্রশ্ন ফাঁসের গুজব আর অভিযোগের মধ্য দিয়েই আজ রোববার শেষ হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। এ গুজব সারা দেশে চাউর ছিল পরীক্ষা শুরুর প্রথম দিন থেকেই। আজ গণিতের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে গত বৃহস্পতিবার থেকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ওয়েবসাইটে এ প্রশ্নপত্রের নমুনা ছড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ অভিভাবকদের। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) তাদের প্রাথমিক তদন্তে এর সত্যতা পেয়ে ৯টি ফেসবুক আই
ডি চিহ্নিত করেছে। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বছর প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই অনেকটা নিষ্ক্রিয় অবস্থান নিয়েছে। গত বছর এ নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করলেও এবার এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। মন্ত্রণালয় প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টিকে নিছক গুজব ভিত্তিহীন অভিযোগ ও তথ্য বিভ্রাট অভিহিত করে প্রেসনোট দিয়েছে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী আকতার হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গতকাল সন্ধ্যায় তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা এবার কঠোরভাবে মনিটরিং করছি প্রতিদিনের পরিস্থিতি। এ ছাড়া একটি প্রেসনোট দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে সতর্ক করা হয়েছে। সেখানে খোঁজ নিতে পারেন। অভিভাবকদের অহেতুক উদ্বিগ্ন না হওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২৬ নভেম্বরের ওই প্রেসনোটে বলা হয়েছে, ‘ফেসবুকে প্রাপ্ত প্রশ্ন বা সাজেশন এবং এ যাবত অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মিলিয়ে দেখা হয়। কোনো প্রযুক্তিগত ত্রুটি বিচ্যুতির কারণে এ ধরনের ঘটনার উদ্ভব কি না তাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কিন্তু সার্বিক পর্যালোচনা শেষে প্রতীয়মান হয় যে, ফেসবুকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রশ্নের সাথে সমাপনী পরীক্ষায় সরবরাহকৃত প্রশ্নের কোনো সামঞ্জস্য নেই। মন্ত্রণালয়ের প্রেসনোটে আরো বলা হয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে মন্ত্রণালয় লক্ষ করছে যে, পরীক্ষা শুরুর পর দিন থেকে বিভিন্ন সামাজিক ও গণমাধ্যমে এ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস সংক্রান্ত বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচার করে যাচ্ছে। প্রচারিত প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি মন্ত্রণালয় প্রথম থেকে গুরুত্বসহকারে বিচার বিশ্লেষণ ও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছে। গত বছর (২০১৩ সালে) প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। কিন্তু এবার প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে মন্ত্রণালয় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ ছাড়া এখনো কোনো তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়নি। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগের খবর গত সপ্তাহের প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা ও ডিপিইর মহাপরিচালক ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে নিয়ে একাধিক বৈঠক করেছেন মাত্র। সেখানে ফেসবুকের প্রশ্নের নমুনা নিয়ে কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই মিল-অমিল খুঁজেছেন মাত্র। এ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল মন্ত্রণালয়ের তৎপরতা। এ দিকে গতকাল রাজধানীর নীলক্ষেত, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ভিকারুননিসা নূন স্কুল, আইডিয়াল স্কুল, উত্তরা এলাকার বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে গণিত প্রশ্ন পাওয়া যাচ্ছে বলে অভিভাবকেরা জানিয়েছেন। রাজধানীর ওই কয়েকটি কোচিং সেন্টারে শনিবার সকালে-বিকেলে কথিত ওই প্রশ্নে কোচিং পড়–য়াদের পরীক্ষা নিয়েছে। তারা অভিযোগ করে বলেন, আগের পরীক্ষাগুলোও ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর প্রতিদিনই ওই কোচিং সেন্টারগুলো পরীক্ষার আগের রাতে ‘সলভ কাস বা নমুনা প্রশ্ন পরীক্ষা’ নিয়েছে। গণিত পরীক্ষার আগে দুই দিনের ছুটি থাকায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে। ঢাকার বাইরে থেকে নয়া দিগন্তের প্রতিনিধিরা বিশেষ করে দেশের বড় বড় শহরে যেখানে ইন্টারনেট সুবিধা রয়েছে সেখানে ‘নমুনা বা সাজেশন আকারে’ গণিত বিষয়ের প্রশ্ন পাওয়া গেছে। হাতেলেখা ও ছাপানো কপি এবং মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে সারা দেশেই পাওয়া গেছে। কথিত ওই প্রশ্ন সংগ্রহ করছেন বলে অভিভাবকেরা আমাদের প্রতিনিধিদের জানান। শনিবার দিনভর অভিভাবকদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা আর প্রশ্ন বিনিময় হয়েছে বলেও জানান। ফেসবুকের সার্চ অপশনে প্রশ্নে নমুনা বা সাজেশন! বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বিটিআরসিও ফেসবুকের সার্চ অপশনে ‘পিএসসি-জেএসসি’ লিখলেই অগণিত পেইজ এখনো খোলা রয়েছে। যেখানে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের শতভাগ নিশ্চিয়তা দেয়া হয়েছে। একটি পেইজে এমনও লেখা আছে, ‘হাতেগুনে ৪০ মিনিট পর গণিত প্রশ্ন দেবো’। আবার কোনো পেইজে কথিত প্রশ্ন দেয়া হয়েছে। সেখানে নৈর্ব্যক্তিক ও কাঠামোগত প্রশ্নও রয়েছে। গত ২৫-২৬ নভেম্বর ডিপিইর মহাপরিচালক নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ পেয়ে প্রাথমিক তদন্তে ৯টি ফেসবুক আইডি চিহ্নিত করা হয়েছে। এ আইডিগুলো বন্ধ করতে বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশনকে (বিটিআরসি) লিখিত অনুরোধ জানিয়েছে অধিদফতর। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত ওই আইডিগুলো সচল ছিল বলে জানা গেছে। এ বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসি কী পদক্ষেপ নিয়েছে? কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে কি না বা এগুলো বন্ধে করণীয় কী হতে পারে? ওই চিঠির কোনো প্রতি উত্তর পাওয়া যায়নি বলে অধিদফতরের মহাপরিচালক জানান। অপর দিকে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ফেসবুক আইডি বন্ধের কোনো বিধান নেই। এটি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কখনই করবেন না। এ ক্ষেত্রে বিকল্পটি হচ্ছে, যেকোনো দেশের টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন অভিযুক্ত ফেসবুক আইডি ব্লক বা জ্যামের সৃষ্টি করতে পারে। এরূপ নজির রয়েছে। কিন্তু এভাবে বিষয়টি কেন ভাবা হয়নি বা করা হয়নি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে ওই সচল অভিযুক্ত ফেসবুক আইডিতে দেয়া প্রশ্নপত্রের নমুনা বা সাজেশনেই এবারের অর্থাৎ ২০১৪ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শেষ হচ্ছে আজ। উল্লেখ্য, গত ২৩ নভেম্বর দেশের বৃহৎ এই পাবলিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ওই দিন ইংরেজি পরীক্ষা ছিল। সেটির প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে তেমন কোনো কথা প্রকাশ না হলেও পরের সব ক’টি প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। এ বছর পঞ্চম শ্রেণীর প্রায় ৩১ লাখ শিশু অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় ২৭ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪৪ জন। আর ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষায় তিন লাখ পাঁচ হাজার ৭২১ জন শিশু অংশ নিচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে সোচ্চার লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল চলমান প্রাথমিক সমাপনীর ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বিষয়ের ফাঁস হওয়া ও মূল প্রশ্নপত্রও তিনি গত বৃহস্পতিবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক নিবন্ধে হাজির করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের শিশুদের লেখাপড়ার দরকার নেই, দোহাই আপনাদের, তাদের ক্রিমিনাল করে বড় করবেন না!’ বেশ কয়েকজন সচেতন অভিভাবক প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ জানিয়ে তাদের হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, সারা বছর আমরা ছেলেমেয়েদের নানাভাবে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করেছি। এখন প্রশ্ন ফাঁস হলে আমরা তাদের কী উত্তর দেবো?
No comments:
Post a Comment