Sunday, November 16, 2014

কাউন্সিলরের কাজ করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা:প্রথম অালো

ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পরিবর্তে প্রশাসক দিয়ে কাজ পরিচালনার কারণে নাগরিকদের সুবিধা তো বাড়েইনি, উল্টো ভোগান্তি বেড়েছে। সিটি করপোরেশনে নাগরিক সেবা পেতে স্থানীয় বাসিন্দাদের এখন যেতে হয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাদের কাছে। সেবার ধরন ও সেবা পাওয়ার সময়ের ওপর নির্ভর করে কোন নেতার কাছে যেতে হবে। কাজ বড় হলে চলে অর্থের লেনদেন। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপ
োরেশনে জনপ্রতিনিধি নেই তিন বছর। করপোরেশনের মূল, আঞ্চলিক ও ওয়ার্ড কার্যালয়গুলো চালান সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে কার্যালয়গুলোর প্রায় সব ধরনের কাজ। এলাকার সমস্যায় এসব নেতাই ওয়ার্ড বা আঞ্চলিক কার্যালয়ে হাজির হন। ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের ছয়টি ও ৯২টি ওয়ার্ডের মধ্য ১৭টি ওয়ার্ড কার্যালয় সরেজমিনে ঘুরে এ চিত্র পাওয়া গেছে। সিটি করপোরেশনের ওই সব কার্যালয়ে গিয়ে এবং সেখানে আসা বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, জনপ্রতিনিধি না থাকায় তাঁদের ন্যূনতম নাগরিক সুবিধাগুলো পেতে এখন তিন থেকে দশ দিনের মতো সময় লেগে যাচ্ছে। কখনো কখনো ছোট কাজের জন্য দু-তিনবারও আসতে হয়। অথচ নাগরিকত্ব বা ওয়ারিশন সনদ আগে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছ থেকে হাতে হাতে নেওয়া যেত। যদিও ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ভাগ করার সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নাগরিক সুবিধা বাড়াতে এটি করা হয়েছে। ২০০৭ সালের মে মাসে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) নির্বাচনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও প্রায় চার বছর মেয়র হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা। ২০১১ সালের নভেম্বরে ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে দক্ষিণ ও ৫৬টি ওয়ার্ড নিয়ে উত্তর নামে দুই ভাগ হয় ডিসিসি। এর পরই দুই সিটি করপোরেশনের জন্য আলাদা প্রশাসক নিয়োগ করে আওয়ামী লীগ সরকার। পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ছয় মাস পর পর প্রশাসক বদল হবে। শ্যামপুর এলাকার ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড (সাবেক ৯০) কমিশনার মো. মোজাম্মেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজধানীতে এখন মানুষের সেবা বলে কিছুই নেই। নাগরিক সনদ, ওয়ারিশন সনদ ফ্রি করে দিতাম। এখন এ জন্য সচিবেরা টাকা নেন। মানুষ রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থার কথা আমাদের কাছে বলতে আসে। কিন্তু আমরা বলি, আমরা তো দায়িত্বে নেই।’ লালবাগের জগন্নাথ শাহ রোডের ৬১ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার আলতাফ হোসেন বলেন, ‘শুধু নাগরিকত্ব সনদ নিতে মানুষের এখন ১০ দিন লাগে। যেটা মানুষ আমাদের কাছে আইলেই পাইত।’ রাজধানীর তেজতুরি বাজারের বাসিন্দা নাসিরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হয় আঞ্চলিক কার্যালয়ে। তিনি নাগরিকত্বের সনদ নিতে এসেছেন। অতি সাধারণ এই কাজের জন্য তাঁকে পড়তে হয়েছে নানা ভোগান্তিতে। তিনি বললেন, ছয় দিন লেগে গেল এই একটি কাজের জন্য। আগে ওয়ার্ড কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়ে নিজেই লিখে একটি সনদ নিয়ে আসতে পারতেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনে জনপ্রতিনিধি নেই। এ জন্য বাসিন্দারা হয়তো কিছুটা অসুবিধায় পড়ছেন। তবে তাঁদের সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যালয়গুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কার্যালয় নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগ নেতারা: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩ (আজিমপুর) এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা এসে আঞ্চলিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিভিন্ন সমস্যার কথা বলছেন। আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের আলাপকালে তাঁর কক্ষে আসেন হাজারীবাগ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইলিয়াসুর রহমান। একই সময়ে আজিমপুর থানা যুবলীগের সভাপতিও তাঁর কক্ষে এসে বিভিন্ন সমস্যার কথা বলেন। ওই এলাকায় কোনো ওয়ার্ড কমিশনার না থাকায় ওয়ারিশন, জন্মসনদ, নাগরিকত্ব সনদ, পাসপোর্টের ফরম সত্যায়িত করতে স্থানীয় কার্যালয়ে আসে মানুষ। ফলে ছোট ছোট কাজের চাপে সারা দিন ব্যতিব্যস্ত সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে অঞ্চল-৩ (আজিমপুর)-এর আঞ্চলিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেকোনো ছোটখাটো সমস্যা হলে এখন মানুষ সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে আসে। কমিশনার থাকলে স্থানীয়ভাবে এটা সমাধান হতো।’ আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এলাকার সমস্যা নিয়েই তাঁরা কথা বলেন। শেওড়াপাড়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা নোমান আরেফিনকে পাওয়া গেল আঞ্চলিক কার্যালয়-৭-এ। তিনি এখন স্বেচ্ছাসেবক লীগ করেন। সড়ক সংস্কার, হোল্ডিং ট্যাক্সসহ কয়েকটি কাজের ব্যাপারে তিনি এসেছেন। কাজগুলো তাঁর কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, এলাকার মানুষের। বিভিন্ন সমস্যা ও জটিলতা মেটানোর জন্য তাঁরা তাঁকে পাঠিয়েছেন। নোমান আরেফিন বলেন, এখন করপোরেশনে অভিযোগ জানানোর মতো কোনো লোক নেই। নির্বাচন হচ্ছে না। এলাকার মানুষ তাঁদের কাছে আসেন। রাজনীতি করলে মানুষের কাজ করতে হয়। বারিধারার সোহরাওয়ার্দী সড়কের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, সাধারণ মানুষকেও ছোটখাটো কিছু সমস্যায় পড়তে হয়। এগুলো সমাধানের জন্য নিজে করপোরেশনে যাওয়ার চেয়ে এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে যাওয়া ভালো। তিনি এটা করিয়ে দেন। জটিল সমস্যায় না পড়লে স্থানীয় বড় নেতারা টাকা নেন না। ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, জোনাল অফিসগুলোতে সারা দিন ক্ষমতাসীন দলের লোকজন বসে থাকেন। বিভিন্ন ধরনের কাজ তাঁরা করেন। নাগরিকদের অনেক অভিযোগ আছে সিটি করপোরেশনের অফিসগুলো নিয়ে। এমনকি স্থানীয় প্রভাবশালী ও কর্মকর্তারা করপোরেশনের স্থানীয় আয় থেকেও কমিশন নিচ্ছেন। পুরো টাকা করপোরেশনের তহবিলে জমা হচ্ছে না। চার বছরে ১২ প্রশাসক: আইন অনুযায়ী প্রতিটি সিটি করপোরেশনে ছয় মাসের জন্য প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। ফলে গত প্রায় চার বছরে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১২ জনকে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অল্প সময়ের জন্য নিয়োগ পাওয়ায় প্রশাসকেরা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চান না। তাঁরা সিটি করপোরেশনের দৈনন্দিন কাজগুলোই মূলত পরিচালনা করেন। দুজন সাবেক প্রশাসক ও একজন বর্তমান প্রশাসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনের একটি বড় কাজ হলো জনসম্পৃক্তমূলক। সেখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগটা ভালো হয় না। তা ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সময় ও চাহিদামতো সেবা করপোরেশনের কাজ থেকে সাধারণ মানুষের পক্ষে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর তাঁদের কাজটা অনেকটা ‘রুটিন ওয়ার্ক’ বলা যায়। ফলে মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জানতে চাইলে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (দক্ষিণ) প্রশাসক ইব্রাহিম হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশন চলবে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে। প্রশাসক বিষয়টি সাময়িক। স্বাভাবিকভাবেই জনপ্রতিনিধি না থাকায় নাগরিকদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। একই অবস্থা উত্তর সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদেরও। এখানকার অভিজাত এলাকাগুলোতে অবস্থিত সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়েরও একই অবস্থা। গুলশান, বারিধারা ও উত্তরার মতো এলাকাগুলোর বাসিন্দাদেরও অভিযোগের শেষ নেই। কারণ, সব কাজেই অনেক সময় লেগে যায়। গুলশানের বাসিন্দা ব্যবসায়ী দবিরুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনের কাজটাই নাগরিকদের নিয়ে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের কোনো দায়বদ্ধতা না থাকায় কাজের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখান না। ছোট ছোট কাজে ঘুষের লেনদেন কম হয়। তাই এগুলো করার ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ কম থাকে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ফারুক জলিল প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে নির্বাচন হচ্ছে না। তা ছাড়া বিশাল জনসংখ্যার শতভাগ সেবা দেওয়ার জন্য সিটি করপোরেশনে পর্যাপ্ত লোকবলের সংকট রয়েছে।

No comments:

Post a Comment