পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা সন্তুরে বাজালেন রাগ চারুকেশী। শুরুতে ছিল ২৫ মিনিটের আলাপ। আলাপের সময় তিনি ছিলেন ধ্যানমগ্ন। সেই ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেই তিনি সন্তুরের মিষ্টি ঝংকারে সম্মোহিত করে ফেললেন রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামের হাজার চল্লিশেক দর্শক-শ্রোতাকে। অবশ্য আগেই দর্শকের উদ্দেশে বলে নিয়েছিলেন, ‘শাস্ত্রীয় সংগীতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আলাপ। এটা অনেক ধ্যান বা প্রার্থনার মতো। আপনারাও ধ্যানমগ্ন হয়ে
সুরকে অনুভব করার চেষ্টা করুন।’ তারও আগে বললেন, ‘আমার বলার মতো ভাষা নেই। ৬০ বছর ধরে সংগীত করছি। এত দর্শক কোথাও দেখিনি। এ অলৌকিক।’ এরপর পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘আমি ভালো বাংলা বলতে পারি না। বুঝি না। কিন্তু আমার সন্তুরের ভাষা আপনারা বুঝতে পারবেন। সংগীতে বুঝতে মেধার দরকার নেই। আত্মা দিয়ে অনুভব করতে হয়।’ তা-ই হলো। উপস্থিত শ্রোতারা পণ্ডিত শর্মার সন্তুরের সুরকে আত্মস্থই করেছেন। শিল্পী শ্রোতাদের টেনে নিয়ে গেলেন কাশ্মীরের সেই পাহাড়ি উপত্যকায়, যেখানে এখনো বাজে সন্তুর, বৈদিক যুগে যা ছিল ‘শততন্ত্রী বীণা’। গত্ বাজাতে গিয়ে শিল্পী চারুকেশীকে নিয়ে সওয়ার হলেন শুরুতে ঝাপতাল এবং শেষে দ্রুত তিনতালের ওপর। তালের তবলা শিল্পী ছিলেন যোগেশ শামসী। রাগটি শেষ করতে তাঁরা সময় নিলেন এক ঘণ্টা ১২ মিনিট। গুরুগম্ভীর মেজাজে শুরু করা রাগটি শেষ করলেন ঝড়ের গতিতে। এরপর আরও বাজানোর অনুরোধ। শিল্পী বললেন, ‘আমি যখন ভারতে বা দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় বাজাতে যাই, অনেকেই প্রশ্ন করেন, তরুণেরা বলিউডি ধুমধাড়াক্কার পাশে উচ্চাঙ্গসংগীত কতটা শোনে? তাদের বলি, তোমাদের প্রশ্নের জবাব এখানে আছে। ঢাকায় এসে দেখে যাও।’ এরপর সংক্ষিপ্ত করে আবারও বাজালেন পাহাড়ি উপত্যকার বাজনা, রাগ পাহাড়ি। গতকাল শনিবারও সুরের অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনা দিয়ে। সম্মিলিত উচ্চাঙ্গসংগীতে অংশ নেন অভিপ্রিয় চক্রবর্তী, সঞ্জীবন স্যানাল, গোল্ডেন মণ্ডল, লতিফুন জুলিও, সারথী মল্লিক, বিটু কুমার শীল, জাহিদুল ইসলাম, বিহাগ জামিল খান, ফারাবি ইসলাম, প্রিয়াঙ্কা দাস, বর্ষা মজুমদার, শর্মিলা মজুমদার, সুস্মিতা দেবনাথ, সোনিয়া হোসেন ও দেবযানী দাস। তাঁরা পরিবেশন করেন সন্ধ্যার রাগ ইমনকল্যাণ অবলম্বনের একটি মিশ্র খেয়াল। এরপর পুরিয়া রাগে সেতার বাজান নিশিত দে। তাঁকে তবলায় সহযোগিতা করেন ইফতেখার আলম। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীতের পাঁচ দিনের মহোৎসবে সার্বিক সহায়তা দিচ্ছে প্রথম আলো। স্কয়ার নিবেদিত বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের এই আয়োজনে আরও সহায়তা দিচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংক, ডেইলি স্টার, এবিসি রেডিও ও মাছরাঙা টেলিভিশন। গতকাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশ্বভারতীর ইমেরিটাস অধ্যাপক শিল্পী যোগেন চৌধুরী ও কলকাতার সংগীত রিসার্চ একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক পণ্ডিত বিজয় কিচলু। স্বাগত বক্তব্য দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবুল খায়ের। উদ্বোধনীর পর শিল্পী মঞ্জুষা পাতিলের ছায়ানট রাগে খেয়াল দিয়ে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় পর্ব। পরের পরিবেশনা অসিত রায়ের ধ্রুপদ, অরুণা সাইরামের কর্ণাটকি সংগীত, কুশল দাশের সেতার ও শেষে উলহাস কাশালকারের কণ্ঠসংগীত। এবার উৎসবের ব্যবস্থাপনা, সাজসজ্জা দৃষ্টিনন্দন। সুপরিসর ও পরিচ্ছন্ন খাবারের স্টলের সংখ্যা বেড়েছে, খাবারের স্টলের বিপরীতেই অনুষ্ঠানের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্টল। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন সামগ্রী। প্রথমার স্টলে বই বিক্রি হচ্ছে ২৫ শতাংশ কমিশনে। এ ছাড়া আছে ডেইলি স্টার-এর স্টল। তাদের প্রকাশনা আছে সেখানে। আছে বেঙ্গল প্রকাশনীর বই ও বিভিন্ন সামগ্রীর পৃথক পৃথক স্টল। আগের রাতের সবিশেষ: প্রতিটি আয়োজনেই একটি বিশেষ মুহূর্ত থাকে। শুক্রবার সেই মুহূর্তটি এসেছিল পণ্ডিত করাইকুডি মানি মঞ্চে এলে। রাত তখন প্রায় আড়াইটা। কর্ণাটকের এই পণ্ডিত মৃদঙ্গমে এবং তাঁর দুই সহযোগী সুরেশ বৈদ্যনাথন ‘ঘটম’ (কলসের আকৃতির একধরনের মৃৎপাত্র) ও অমৃৎ নটরাজ ‘কাঞ্জিরা’ (এক হাতে বাজানো তালযন্ত্র) যা করলেন, তা কানে না শুনলে, চোখে না দেখলে বলে বোঝানো অসম্ভব। ঘণ্টা দেড়েক তাঁরা কখনো এককে, কখনো দ্বৈতে এবং তিনজনে মিলে কত বিচিত্র তালে, কত অভিনব ছন্দে যে বাদন পরিবেশন করলেন, সম্ভবত উপস্থিত বেশির ভাগ দর্শকের তা আগে চোখে দেখার অভিজ্ঞতা ছিল না। আজকের পরিবেশনা: আজ রোববার চতুর্থ দিনের শুরুতে থাকবে অমিত চৌধুরীর ভরতনাট্যম, স্বরূপ হোসেনের তবলা। পরে থাকবে আমান আলী খান ও আয়ান আলী খানের সরোদ, সামিহান কাশালকারের কণ্ঠসংগীত, তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার ও গণেশ রাজগোপালনের সরোদ বেহালা যুগলবন্দী, কৌশিকী চক্রবর্তীর কণ্ঠসংগীত এবং হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি।
No comments:
Post a Comment