চলমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত বাংলা পরীক্ষার প্রশ্ন পরীক্ষা শুরুর আগেই বগুড়া, দিনাজপুরসহ কয়েকটি এলাকায় ফাঁস হয়, যা মূল প্রশ্নের সঙ্গে মিলে গেছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। টাঙ্গাইলের বাসাইলে হাতে লেখা প্রশ্নপত্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিলির উদ্দেশে ফটোকপি করার দায়ে এক কিন্ডারগার্টেনের মালিক ও এক ফটোকপি ব্যব
সায়ীকে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত রোববার এই পরীক্ষা শুরুর দিনেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ করেছিলেন একাধিক অভিভাবক। তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর এই অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে সাংবাদিকেরা পরীক্ষার পর প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগের কথা জানিয়েছেন। পরীক্ষার পর বললে তো আর লাভ নেই।’ উল্লেখ্য গতবারও এই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল, যা তদন্তে প্রমাণিত হয়। বগুড়ায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে মূল প্রশ্নের মিল!: প্রথম আলোর বগুড়া প্রতিনিধি জানান, বগুড়ায় কোচিং সেন্টারে অভিযান চালিয়ে পরীক্ষার আগের দিন রোববার শিক্ষকদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া সমাপনী পরীক্ষার হাতে লেখা প্রশ্নের সঙ্গে গতকাল অনুষ্ঠিত বাংলার প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় চার শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল পরীক্ষা শুরুর পর বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুর রহিম ছাপানো প্রশ্নপত্রের সঙ্গে গত রোববার সন্ধ্যায় শহরের জ্বলেশ্বরীতলার মোহনা কোচিং সেন্টার থেকে উদ্ধার করা হাতে লেখা প্রশ্নপত্র মিলিয়ে দেখেন। গতকাল দুপুরে ইউএনও আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ১০০ নম্বরের পরীক্ষার মধ্যে কোচিং সেন্টার থেকে উদ্ধার হওয়া হাতে লেখা প্রশ্নপত্রের অন্তত ৮০ নম্বরের মিল রয়েছে। প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর কোন বইয়ের কত নম্বর পাতায় রয়েছে, তাও হাতে লেখা প্রশ্নপত্রে উল্লেখ ছিল। ইউএনও বলেন, কোচিং সেন্টারে অভিযানের সময় সেখানে মুঠোফোনে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে খাতায় লিখছিলেন শিক্ষকেরা। কেউ কেউ মুঠোফোনেই তা শিক্ষার্থীদের কাছে বলছিলেন। সময় পেলে তাঁরা হয়তো আরও ২০ নম্বরের প্রশ্নও সংগ্রহ করতেন মুঠোফোনেই। কোচিং সেন্টারে বসে মুঠোফোনে প্রশ্ন ফাঁসের সময় ইউএনওর নেতৃত্বে চালানো ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় চার শিক্ষককে। তাঁরা হলেন: গাবতলী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুবুর রহমান, আটঘরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম এবং গোড়দহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম সরোয়ার ও ইয়াকুবিয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহিন কাদির। রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক মো. আবদুর রহিম গাবতলীর তিন শিক্ষককে এক বছর করে কারাদণ্ড এবং ইয়াকুবিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল কাদিরের পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন। বগুড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুস সালাম প্রথম আলোকে জানান, ওই তিন প্রাথমিক শিক্ষককে গতকাল সাময়িক বরখাস্ত করে বিভাগীয় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীর জেলাতেই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ: প্রথম আলোর বিরামপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই জেলায় বাড়ি প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের। পরীক্ষার আগের দিন রোববার রাত ১২টা ৫৬ মিনিটে নবাবগঞ্জ উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রথম আলোর বিরামপুর প্রতিনিধিকে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি জানান। পরে প্রথম আলোর প্রতিনিধি গতকাল সকাল সাতটা ৫৩ মিনিটে মুঠোফোনে নবাবগঞ্জের ইউএনও সৈয়দ ফরহাদ হোসেনকে এবং সকাল আটটা ছয় মিনিটে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা একরামুল হককে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি অবগত করেন। পরীক্ষা শুরুর প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা আগে ওই প্রধান শিক্ষক সকাল নয়টা ৪৮ মিনিটে মুঠোফোনে প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে গতকাল অনুষ্ঠিত বাংলা পরীক্ষার ১৩টি প্রশ্ন বলেন। সেই সঙ্গে ওই প্রধান শিক্ষক জানান, উপজেলার ভাদুরিয়া বাজারের মসজিদসংলগ্ন একটি ফটোকপির দোকানে এসব প্রশ্নপত্র ফটোকপি করে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রথম আলোর প্রতিনিধি মুঠোফোনে বিষয়টি দিনাজপুর গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক বজলুর রশিদকে জানান। পরীক্ষা শুরুর পর উপজেলার শালখুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিত ইউএনও, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আমিরুল ইসলাম, পরীক্ষাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আহসান মাহমুদ এবং ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাসরিন বেগমের সামনে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মিলিয়ে দেখলে ১৩টি প্রশ্নই মিলে যায়। ইউএনও সৈয়দ ফরহাদ হোসেন বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি জানার পর থানায় গিয়ে প্রতিটি প্রশ্নপত্রের খাম ভালোভাবে দেখেছেন। সেখানে প্রতিটি খাম সিলগালা অবস্থায় ছিল। বাসাইলে কারাদণ্ড: সখীপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, জেলার বাসাইলে হাতে লেখা প্রশ্নপত্র নিজের প্রতিষ্ঠিত কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিলির উদ্দেশে ফটোকপি করার দায়ে কিন্ডারগার্টেনের মালিক হারুনুর রশিদকে দুই বছরের ও ফটোকপি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলামকে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। দণ্ডিত হারুনুর রশিদ বাসাইলের কাঞ্চনপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও বাসাইলের শামীম স্মৃতি শিক্ষালয় নামের চারটি কোচিং সেন্টারের মালিক। গতকাল দুপুরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক বাসাইলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান তাঁর কার্যালয়ে আদালত বসিয়ে এ সাজা দেন। নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর জানান, রংপুরের পীরগাছার কৈকুড়ি ইউনিয়নের ১ নম্বর চৌধুরানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে উত্তরপত্র লিখে দেওয়ার সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পাঁচ শিক্ষককে হাতেনাতে ধরে তাঁদের কেন্দ্র থেকে অব্যাহতিসহ প্রত্যেকেকে তিন হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। এই পাঁচ শিক্ষক হলেন: উপজেলার কৈকুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম, কুতুববাজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আতোয়ার হোসেন, মোংলাকুঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুফিয়া বেগম, শাহাদত হোসেন ও দক্ষিণ কৈকুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রুমি আকতার। এ ছাড়াও দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে কেন্দ্রসচিব সোনিয়া আনসারীকে কেন্দ্র থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁকেও তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment