Thursday, November 27, 2014

একযোগে কাজ করার তাগিদ:প্রথম অালো

তিন দশক আগে যাত্রা শুরু হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী এগোতে পারেনি সার্ক। তাই জনগণের বৃহত্তর কল্যাণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে একযোগে কাজ করার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে এগিয়ে যেতে হবে। এ লক্ষ্যে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ আর বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা জরুরি। গতকাল বুধবার সকালে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) ১৮তম শীর্ষ সম্মেলনে সদস্য আট দেশের শীর্ষ নেতাদের বক্তৃতায় এ বিষয়গুলো উঠে এসেছ
ে। কাঠমান্ডুর সিটি হলে সার্ক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে দেওয়া বক্তৃতায় সার্ক নেতারা এ অঞ্চলের দেশগুলোতে ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী হওয়ার ব্যাপারে নিজেদের সন্তোষের কথা জানিয়ে এখন একযোগে সময়সীমাভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দেন। সার্ক শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে গতকাল বুধ ও আজ বৃহস্পতিবার নেপালে দুই দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পাশাপাশি যান চলাচলের ওপর যথেষ্ট কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ১৯৮৭ ও ২০০২ সালের পর এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো সার্ক সম্মেলনের আয়োজন করেছে নেপাল। উদ্বোধনী অধিবেশন: কাঠমান্ডুর পুনর্নির্মিত সিটি হলে সকাল সাড়ে নয়টায় নেপালের জাতীয় সংগীত বাজিয়ে শুরু হয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন। ১৭তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের চেয়ারপারসন ও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এরপর সূচনা বক্তৃতা দেওয়ার পর সার্ক দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের পক্ষ থেকে তিনি নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালাকে মঙ্গলদ্বীপ জ্বালানোর জন্য আমন্ত্রণ জানান। মঙ্গলদ্বীপ জ্বালানোর সময় ‘মঙ্গল ধুন’ বাজান বাদ্যযন্ত্রীরা। এরপর নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা স্বাগত বক্তব্য দেন। এরপর তাঁকে ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের চেয়ারপারসন হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এরপর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে প্রথম বক্তৃতা দেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। একে একে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আশরাফ ঘানি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লিওনছেন শেরিং টোবগে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম বক্তব্য দেন। সবশেষে বক্তব্য দেন সার্ক সচিবালয়ের মহাসচিব অর্জুন বাহাদুর থাপা। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেট মেসনের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে শুরু হয় পর্যবেক্ষকদের বক্তৃতাপর্ব। এরপর চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিউ ঝেনমিন, ইরানের সড়ক ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী আব্বাস আখুনদি, দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিবিষয়ক উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী লি কিউং সু, মিয়ানমারের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থিন ও লিন এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেসাই বিসওয়াল বক্তৃতা দেন। এ ছাড়া কাঠমান্ডুতে জাপানের রাষ্ট্রদূত মাশাহি ওগাওয়া জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার বক্তৃতা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বক্তব্য নেপালে ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনসে টিরিঙ্ক পড়ে শোনান। নেতাদের বক্তৃতা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমৃদ্ধির জন্য মতপার্থক্য দূরে সরিয়ে রেখে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিতে সার্কের সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সার্ক এ অঞ্চলের জনগণের প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ করতে পারেনি। অতীতের দিকে তাকালে যে কারও মনে হবে যে আমাদের প্রত্যাশা ও সম্ভাবনার তুলনায় অর্জন অনেক কম। সম্মিলিত রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও লক্ষ্য সার্কের উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হতে পারে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সমঝোতা বাস্তবায়নে সহযোগিতার জন্য আমি এই মঞ্চে বসা সার্কের সব নেতার প্রতি আহ্বান জানাই। আঞ্চলিক মোটরযান চুক্তি ও আঞ্চলিক রেলওয়ে চুক্তি দ্রুত সই হবে বলে বাংলাদেশ আশা করছে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘সার্ক দেশগুলোর দ্রুত আঞ্চলিক বাণিজ্যের ওপর জোর দেওয়া উচিত। দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) কার্যকর বাস্তবায়নও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জনগণ কার্যকর জোরালো উদ্যোগ দেখতে চান। প্রক্রিয়ার চেয়ে ফলাফলের দিকেই তাদের আগ্রহ বেশি।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘গত তিন দশকে সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সার্ক অনেক সাফল্য পেয়েছে। এর পরও সার্কের প্রসঙ্গ এলে আমরা সাধারণত অন্যের প্রতি দোষারোপ আর সংশয় এ দুটি প্রতিক্রিয়াই লক্ষ করি। দুঃখজনক হচ্ছে, আশাবাদী তরুণ জনগোষ্ঠী-অধ্যুষিত একটি অঞ্চলেই এমন প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ে।’ নরেন্দ্র মোদি বলেন, ধীরে ধীরে হলেও সার্কভুক্ত দেশগুলো একীভূত হচ্ছে। রেল, সড়ক, বিদ্যুৎ আর ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিবিড় হচ্ছে। ভারত ও নেপাল জ্বালানি সহযোগিতার নতুন যুগে প্রবেশ করছে। বাস-ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে জনগণের প্রত্যাশা আর সদস্য দেশগুলোর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সার্ক ব্যর্থ হয়েছে। অবকাঠামোগত সমস্যাকে এ অঞ্চলের প্রধান সমস্যা হিসেবে অভিহিত করে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘এ অঞ্চলে যোগাযোগ ও বাণিজ্য বাড়াতে অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ভারতে একটি বিশেষায়িত ব্যবস্থা চালু করতে চাই। আমরা ভারতে ব্যবসাপ্রক্রিয়া নমনীয় করার কথা বলছি। এ প্রক্রিয়া এ অঞ্চল পর্যন্ত¯বিস্তৃত করা যায়। আসুন আমরা সবাই মিলে প্রক্রিয়াগুলো নমনীয় করি। ভারত সার্কভুক্ত দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের জন্য তিন থেকে পাঁচ বছরের ভিসা দেবে। আসুন সার্ক বিজনেস ট্রাভেলার কার্ড চালু করে এ প্রক্রিয়াটি আরও সহজ করি।’ নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধির জন্য এ অঞ্চলকে নিরাপদ রাখাটা জরুরি। আসুন সন্ত্রাসবাদ ও আন্তসীমান্ত¯অপরাধ দমনে আমাদের অঙ্গীকার পূরণে কাজ করি।’ তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বাণিজ্য, বিনিয়োগ, বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা, জনগণের যোগাযোগ এবং নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ—এ পাঁচটি বিষয়ে ভারতের পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা সবাই আমাদের গন্তব্য ঠিক করতে পারি। কিন্তু আমরা যখন একসঙ্গে একই গতিতে চললে পথটা সহজ হয়ে যায়, যাত্রা দ্রুততর আর গন্তব্যটা অনেক কাছে হয়ে যায়।’ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সস্তায় জ্বালানি প্রাপ্যতার বিষয়টি সরাসরি যুক্ত। তাই এ অঞ্চলে বিকল্প জ্বালানির উৎসের প্রাপ্যতার বিষয়টিতে সম্মিলিতভাবে মনোযোগ দেওয়া উচিত। পাশাপাশি ত্রিদেশীয় তেল ও গ্যাস পাইপলাইন চালুর বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তিনি যোগাযোগ নেটওয়ার্ক জোরদার আর ভিসাপ্রক্রিয়া সহজ করার তাগিদ দেন। নওয়াজ শরিফের মতে, সার্কের অঙ্গীকার আর বাস্তবতার ব্যবধানটা কমানো উচিত। এ অঞ্চলের জনগণের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে নিজেদের মতপার্থক্য ভুলে একসঙ্গে কাজ করা উচিত। নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় অভিন্ন অর্থনৈতিক ইউনিয়ন চালু করার লক্ষ্যে সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশপথে যোগাযোগ ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে পণ্য, সেবা, বিনিয়োগ ও জনগণের চলাচল বাড়াতে হবে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার তিন দশক পর সার্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে পৌঁছেছে। লক্ষ্যপূরণে গতানুগতিক উদ্যোগের বদলে এখন ফলভিত্তিক উদ্ভাবনী উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, এটি সরাসরি আমাদের জনগণের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে।’ রাজাপক্ষে বলেন, ‘সার্কের চর্চা হলো অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিশেষ করে রাজনৈতিক বিষয়ে নাক না গলানো। আমাদের অবশ্যই সম্মিলিতভাবে বাইরের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে হবে। সার্কের আদর্শ ধারণ করে সদস্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে বাইরের হুমকি সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে হবে।’ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোবগে বলেন, সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে আন্তসীমান্ত¯সন্ত্রাসবাদ, মানব ও মাদক পাচারের মতো অভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে। এ ছাড়া একইভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও দারিদ্র্যের মতো সবার অভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা এবং আন্ত-অঞ্চল বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে সমৃদ্ধ অঞ্চল গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব।

No comments:

Post a Comment