Tuesday, December 23, 2014

অপরাধ বাড়ছে ফেসবুক ঘিরে:নয়াদিগন্ত

‘সময় যেন আর কাটে না... বড় একা একা লাগে’Ñ সামিনা চৌধুরীর কণ্ঠে এমন রোমান্টিক গান কার না ভালো লাগে। সময় কাটানোর জন্য ব্যস্ততম জীবনে প্রযুক্তির ডানায় ভর দিতে গিয়ে কারো কারো সংসারে জ্বলছে তুষের আগুন। বাড়ছে বিয়ের বাইরে সম্পর্ক, অসম প্রেম-পরকীয়া-ব্ল্যাকমেইল। সেখান থেকে শুরু হয়েছে খুন-খারাবি ও অপহরণ।  বিশ্বজুড়েই জনপ্রিয় ফেসবুক। বাংলাদেশে অর্ধকোটি মানুষ সামাজিক যোগাযোগের এ সাইট ব্যবহার করে থাকেন। ইন্টারনে
টে কন্টেন্ট স্বল্পতার সুযোগে ফেসবুককেই প্রমোট করেন মোবাইলফোন অপারেটররা।  ফেসবুক যেমন ভালো কাজে ব্যবহার হচ্ছে; তেমনি খারাপ কাজেও। তবে ফেসবুকে কিছু অপরাধ এতটাই বাড়ছে যেটি এখন উদ্বেগ ও আতঙ্কে পৌঁছে গেছে। কারো মতে, এটা এক ধরনের আসক্তিতে পরিণত হয়েছে।  সর্বশেষ গত মাসে চট্টগ্রামের একটি ঘটনা সবাইকে নাড়া দিয়েছে। অল্পবয়সী এক ছাত্রীর সাথে ফেসবুকে মধ্যবয়সী এক পুরুষ সমবয়সী সেজে সম্পর্ক গড়ে। পরে তারা দেখা করতে গিয়ে মেয়েটির ভুল ভাঙলেও তাকে দেড় মাস আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে মধ্যবয়সী ওই পুরুষ বন্ধু।  অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফেসবুক ঘিরেই গড়ে উঠছে নানা রকমের চক্র। যৌনাসক্ত, মাদকাসক্ত, অপহরণ ও অপকর্মের ফাঁদ হিসেবেও এটি এখন প্রতিষ্ঠিত।  নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এ রকম বহু ঘটনা; যেখানে ফাঁদে পা দিয়ে সম্মান-শান্তি এবং টাকা খুইয়েছেন অনেকে।  একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন রেজা (ছদ্মনাম)। ফেসবুক ব্যবহারে তার কমতি নেই। এখানে তিনি খপ্পরে পড়েন একদল তরুণীর। যারা একটি গ্যাংয়ের হয়ে কাজ করে। তাদের গুরু হলো হাসান পারভেজ।  রেজা নয়া দিগন্তকে বলেন, একটি মেয়ের সাথে তার বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার সাথে তিনি দেখাও করেন। দ্বিতীয়বার দেখার পর তাকে অপহরণ করে গ্যাংয়ের লোকজন। টাকা চায় তারা। টাকা না পেয়ে তাকে প্রচণ্ড মারধর করে। রেজার একজন বন্ধু পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তা। তার কাছে সহায়তা চেয়ে শেষ পর্যন্ত প্রাণে রক্ষা। তবে শেষ রক্ষা তার হয়নিÑ লেডি গ্যাং তার পিছু ছাড়েনি। তাদের দলের এক সদস্য রিপা হায়াত। সে বিভিন্নজনকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। আর ফাঁদ পাতে; ফোন করে।  তাদের বস রেজাকে হয়রানি করে যাচ্ছে। টাকা না দিলে খুনের হুমকি দিচ্ছে। রেজার নগ্ন ছবি তুলে রেখেছে ওই গ্যাং। বাধ্য হয়ে মামলা ঠুকেছেন রেজা; তবে সে মামলারও গতি নেই।  ব্যস্ততম নগরজীবন থেকে শুরু করে গ্রামীণ জনপদেও ফেসবুক হয়ে উঠছে এক দানবীয় সংসার ভাঙার হাতিয়ার হিসেবে। এখানে অনেকেই জড়িয়ে পড়ছেন এমন সম্পর্কে যার কোনো ব্যাখ্যা করা যায় না।  ব্যস্ত স্বামীর মুক্ত স্ত্রী পর্দাটা টেনে দিয়েই বসে পড়েন ফেসবুকের উন্মুক্ত জানালায়। সেখানে পুরুষ তো পড়ি মরি করেই খুঁজে বেড়াচ্ছে তার সঙ্গী। নারীরাও কম যান না। মধ্যবয়সী নারীদের মধ্যে একটা অংশ তাদের ফেসবুক উন্মুক্ত রাখেন অল্প বয়সী পুরুষদের জন্য।  ফেসবুক ব্যবহারের ওপর নজর রাখছেন এমন একজন প্রযুক্তিবিদ নয়া দিগন্তকে বলেন, একজন নারী ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট ওপেন করা মাত্রই ডজনে ডজনে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেতে শুরু করেন। এর মধ্যে এমন অনেক সম্মোহনকারী রয়েছেন, যারা নারীকে বেঁধে নেন আবেগে; ভালোবাসায় এবং শেষে শারীরিক সম্পর্কে।  সূচনা (ছদ্মনাম) ঢাকার একটি মধ্যবিত্ত বসবাসকারী এলাকায় স্বামীর সাথে থাকেন। তার মতে, স্বামী অফিসে চলে যাওয়ার পর তার খুব একটা কাজ থাকে না। বাসার নৈমিত্তিক কাজগুলো ‘বুয়া’ করে থাকেন। রান্নাটা তাকে করতে হয়। ফাঁকে লম্বা সময় সিরিয়াল দেখা আর ফেসবুকিং।  এর মধ্যে তার সাথে একাধিক পুরুষের পরিচয় হয়েছে। তাদের সাথে ‘হট চ্যাট’ হয়ে থাকে। হট চ্যাট হলো সাইবার জগতের অশ্লীল আলাপ। ছবি বিনিময়ও করে থাকেন। তার মতে, বিষয়টা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তিনি এটা করছেন নিজের আনন্দের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্টুডেন্ট কাউন্সিলর বলেন, আমরা আমাদের সময় যে কথা মুখ ফুটে বলতে পারতাম না সেটি এখন নিমিষেই চ্যাট বক্সে বলে দিচ্ছেন যে কেউ। মুখোশের আড়ালে মানুষের যে কত রকমের রূপ; সেটি ফেসবুকের কল্যাণে সবার কাছেই চলে আসছে।  নেত্রকোনোর মেয়ে রিমঝিম (ছদ্মনাম)। ফেসবুক ব্যবহার করে অনেকের সাথে চুটিয়ে প্রেম করে যাচ্ছেন। ডেট করছেন; সেসব ছবি আবার ফেসবুকে আপলোড করছেন। তার মতে, স্বামী এসবে গা করে না। তনে নিশার (ছদ্মনাম) মতটা ভিন্ন। স্বামীরাও এমনটা করছেন। যেটি আমরা জানতে পারছি না। সুজানা (ছন্দনাম) রাজধানীর একটি ফ্যাশন হাউজে কাজ করেন। তিনি বলেন, আমার স্বামীর ফেসবুকে এত মেয়ে ফ্রেন্ড; তাকে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে ক্ষেপে যায়। মাঝে মাঝে তার আচরণ খুব অদ্ভুত মনে হয়। কিন্তু বিষয়টা আমি কারো সাথে শেয়ার করতে পারি না। করলে স্বামীকে লোকে চরিত্রহীন বলবে।  কেবল ফেসবুকই হোয়াটঅ্যাপ আর ভাইবারও এখন একই রকমের সঙ্কটগুলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহার করে অনেকে আবার টাকাও কামাচ্ছেন। ফেসবুকে কেবল ঢাকা থেকে সেক্স ট্রেড হয় এমন লোকদের এক হাজারের বেশি ফেসবুক পেজ রয়েছে; যেখানে নারী-পুরুষ সবাইকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ফোন নম্বর এবং বিক্যাশ করে অগ্রিম দেয়ার নম্বর দিয়ে এ নিয়ে আলাপ হচ্ছে।  বছর তিনেক আগে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলেছিল পর্নোগ্রাফির কবলে পড়েছে ফেসবুক। সে সময় এটা নিয়ে খুব একটা আলাপ না হলেও সময়ের সাথে এটি আলোচনার দাবি রাখে বলে মনে করেন ব্লগার রাজিব।  ফেসবুক-কেন্দ্রিক অপরাধ নিয়ে গবেষণা না হলেও এখানে যে অপরাধপ্রবণতা ও বিয়েবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক বাড়ছে; তাতে কোনো সন্দেহ নেই বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবিদ। তিনি বলেন, একটা ছেলে বন্ধু কিংবা একটা মেয়ে বন্ধু এখন যেন অতীত হতে চলেছে। ফেসবুকে ও বাস্তব জীবনে বন্ধুত্বের নামে যা হচ্ছে তাকে কোনোভাবেই সুখকর বলা যাবে না।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক নাসরিন ওয়াদুদ বলেন, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। প্রযুক্তির সুফল যেমন আছে, তেমনি এর কিছু নেতিবাচক বিষয়ও আছে। সেটি সবাইকে বোঝাতে হবে। বিশেষ করে নিজের সন্তানকে। তাকে চাপ প্রয়োগ না করে বুঝিয়ে বললে সে নিশ্চয় বুঝবে।  ফেসবুকেই অনেকে দিনের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করছেন। মোবাইলফোনগুলোতে এখন ফেসবুক ব্যবহারের সহজ অপশন রয়েছে। যে কেউ ইচ্ছে করলে তার ফোনটি ইন্টারনেট অ্যানাবল না হলেও ফেসবুক ব্যবহার করতে পারেন। সে জন্য তাকে এসএমএসের সহায়তা নিতে হয়।  ফেসবুকের এ ব্যবহার যে যথেচ্ছ পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে সন্দেহ নেই। তরুণেরা রাত জেগে ইন্টারনেটে সময় কাটাচ্ছেন। এতে করে পড়াশোনার তি তো হচ্ছে, সেই সাথে স্বাস্থ্যহানিও ঘটছে। এসব নিয়ে অনেক অভিভাবক উদ্বিগ্ন।  মিরপুরের মোস্তাফিজ বলেন, ছেলেমেয়েদের ফেসবুকে থাকার প্রবণতা এত বেশি যে, ওরা সময় পেলেই বা সময় বের করে ফেসবুকে বসে থাকে। রাত-বিরাতেও ফেসবুকে থাকে। নিজের সন্তান নিয়ে তাই আমি উদ্বিগ্ন। রাত জেগে ফেসবুকে আড্ডার কারণে তার পড়াশোনায় যেমনি তি হচ্ছে, তেমনি তি হচ্ছে স্বাস্থ্যের। কিন্তু এর আসক্তি এতটাই বেড়েছে, নিজের সন্তানকে আয়ত্তে আনা মুশকিল হয়ে পড়েছে। এ রকম আরো অনেক বাবা-মা রয়েছেন উল্লেখ করে মোস্তাফিজ আরো বলেন, আমার সাথে এ রকম অনেকের আলাপ রয়েছে। শুরুর দিকে আমরা এটাকে খুব একটা আমলে নিইনি। কিন্তু এখন দেখছি আমলে না নিয়ে উপায় নেই।  অতিরিক্ত সময় ফেসবুকে থাকাটা সমীচীন নয় বলেই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিার্থী ফুয়াদ।  তিনি বলেন, এর একটা সীমা থাকা উচিত। বেশিণ কমপিউটারের সামনে বসাটাই আমার কাছে বিরক্তিকর। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে কিন্তু যেটি আসক্তির পর্যায়ে যায় সেটা কোনোভাবেই ঠিক নয়।  তবে তার সাথে দ্বিমত করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিার্থী লিমা বলছেন, এটা খারাপ কোনো নেশা নয়। এর মধ্য দিয়ে দেশে ও দেশের বাইরের বন্ধুদের সাথে আমরা যোগাযোগ রাখতে পারি। তা ছাড়া আমরা নিজেদের মধ্যে অনেক কিছু শেয়ার করতে পারি। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয় উল্লেখ করে ফুয়াদ বলছেন, এটা খুবই খারাপ যে কেউ ফেসবুক বন্ধের কথা বলছেন।  এটা একটি সামাজিক যোগাযোগের সাইট, তবে আমি অস্বীকার করছি না এতে এমন অনেক অসামাজিক কার্যকলাপ রয়েছে, যাকে সমর্থন করা যায় না। তবে সব ভালোর তো কিছু খারাপ দিক থাকতেই পারে।  মার্কিন তরুণ মার্ক জাকারবার্গ মূলত তার ক্যাম্পাসের বন্ধুদের সম্পৃক্ত রাখতে এ ধরনের একটি ওয়েবসাইট খোলেন। এখন এটি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসাসফল উদ্যোগ।

No comments:

Post a Comment