Tuesday, December 16, 2014

১৮৫ প্রত্নবস্তু ও তিন হাজার প্রকাশনা উধাও:প্রথম অালো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর থেকে প্রাচীন মূর্তি, টেরাকোটাসহ ১৮৫টি প্রত্নবস্তু, অসংখ্য প্রকাশনা এবং মুদ্রা ও বই খোয়া গেছে। সম্প্রতি জাদুঘরের উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় জাদুঘরের একজন পরিচালক আনুষ্ঠানিকভাবে সব প্রত্নসম্পদের হিসাব বুঝিয়ে দেননি। এ ঘটনায় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ কমিটি করে ইনভেন্টরি (মজুত) প্
রতিবেদন প্রস্তুত করতে গিয়ে এই খোয়া যাওয়ার ঘটনা বুঝতে পারে। এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পুরো বিষয়টি রিভিউ করার জন্য একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, জাদুঘরে মুদ্রা ছাড়া নিবন্ধিত নানা ধরনের প্রত্নবস্তুর সংখ্যা চার হাজার ৪০৭টি। এর মধ্যে ১৮৫টি আর পাওয়া যাচ্ছে না। নিবন্ধিত মুদ্রা ছিল পাঁচ হাজার ৯৭১টি। তার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না ৩৩টি। গ্রন্থের সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৯৩৩টি। পাওয়া যাচ্ছে না ৮৫টি। প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৫৭৬টি। তার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না তিন হাজার ৫২টি। এ প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে পুস্তক, পুস্তিকা, গ্রন্থ জার্নাল ইত্যাদি। নিখোঁজ প্রত্নবস্তুর মধ্যে রয়েছে উমা মহেশ্বর বা শিব-পার্বতীর মূর্তিসহ একাধিক বিষ্ণুমূর্তি, সূর্যমূর্তি, বুদ্ধমূর্তি ও বুদ্ধস্তূপ। এ ছাড়া রয়েছে দুর্লভ টেরাকোটা, কারুকার্যখচিত ইট ও অন্যান্য প্রত্নবস্তু। যেভাবে ধরা পড়ল: জাদুঘর পরিচালনার জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ রয়েছে। পরিষদের গত সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত বিশেষ সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৬ সালের ৩১ জানুয়ারি জাদুঘরের প্রয়াত পরিচালক মুখলেছুর রহমানের কাছে থেকে সাইফুদ্দীন চৌধুরী পরিচালক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সে সময় সাইফুদ্দীন চৌধুরী জাদুঘরের সব প্রত্নসম্পদসহ মুদ্রা, প্রকাশনা, লাইব্রেরির বইপত্র, আসবাব, ফাইলপত্রসহ সব ধরনের জিনিস ইনভেন্টরি (মজুত) প্রতিবেদন করে বুঝে নেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে চিঠির মাধ্যমে তা জানানো হয়েছিল। ২০০৪ সালে ডিসেম্বর মাসে এমন ইনভেন্টরি প্রতিবেদন না দিয়ে একটি ছোট চিঠি দিয়ে সাইফুদ্দীন চৌধুরী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগে যোগ দেন। জাদুঘরের উপপরিচালক মো. জাকারিয়াকে দায়িত্বভার হস্তান্তর করেন। জাকারিয়া তখন থেকে ২০১১ সালের ২ নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এখন তিনি জাদুঘরের উপপরিচালক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন থেকে জাদুঘরের দায়িত্ব হস্তান্তরের বিষয়ে তৎকালীন পরিচালক মো. জাকারিয়াকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হলেও নানা অজুহাতে দেখিয়ে তিনি কালক্ষেপণ করেন। অবশেষে ২০১০ সালের ৩০ জুন সাইফুদ্দীন চৌধুরী ও জাকারিয়ার মধ্যে দায়িত্ব হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। জাদুঘর পরিষদের গত ৫৭তম সভায় অধ্যাপক সুলতান আহমদকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি নতুন ইনভেন্টরি কমিটি গঠন করে। কমিটি দুই বছর ধরে কাজ করে ১০০ বছরের সংগৃহীত প্রত্নসম্পদসহ সব বিষয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করে। সাবেক পরিচালক মুখলেছুর রহমানের প্রতিবেদনের সঙ্গে এই প্রতিবেদন মেলাতে গিয়ে প্রচুর গরমিল পাওয়া যায়। এ থেকেই জাদুঘরের প্রত্নসম্পদ নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে। সাইফুদ্দীন চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ায় ব্যস্ত ছিলাম। তাই দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে দেরি হয়।’ তবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার সময় তিনি একটি ইনভেন্টরি প্রতিবেদন দিয়েছিলেন বলে দাবি করেন। যদিও তাঁর কাছে থেকে দায়িত্ব বুঝে নেওয়া মো. জাকারিয়া এমন প্রতিবেদন পাননি বলে জানান। জাকারিয়া বলেন, সাইফুদ্দীন চৌধুরী জাদুঘরের ছাড়পত্র ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন। এটা হয় না। সাবেক এই দুই পরিচালকের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, তাঁরা ক্যাশমেমো ছাড়াই বই বিক্রি করেছেন। বিক্রির টাকা ব্যাংকে জমা দেননি। এ ছাড়া তাঁদের সময় প্রত্ন নিদর্শন, মুদ্রা ও টেরাকোটা ফলকে দ্বৈত নম্বর বসানো হয়েছে। বিপুলসংখ্যক প্রত্ন নিদর্শন, মুদ্রা তালিকাভুক্ত করা হয়নি। এসব বিষয়ে সাবেক পরিচালক সাইফুদ্দীন চৌধুরীর কাছে ছয়টি এবং জাকারিয়াকে ১১ বিষয়ে জবাবদিহি করতে বলা হয়েছে। জানতে চাইলে বর্তমান পরিচালক সুলতান আহমদ বলেন, জাকারিয়া ও সাইফুদ্দীন চৌধুরী এসব বিষয়ে পাশ কাটানো জবাব দিয়েছেন। উপদেষ্টা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গঠিত উপকমিটি ঘটনার জন্য সাবেক পরিচালক সাইফুদ্দীন চৌধুরী ও জাকারিয়াকে দায়ী করেছে। খোয়া যাওয়া প্রকাশনার মূল্য বাবদ এক লাখ ১৯ হাজার টাকা তাঁদের দুজনের কাছ থেকে আদায়, তাঁদের আর কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব না দেওয়া এবং জাকারিয়াকে জাদুঘর থেকে সরানোর সুপারিশ করা হয়েছে। সাইফুদ্দীন চৌধুরী এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘তদন্ত কমিটির আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে কি না বুঝতে পারছি না।’ এ বিষয়ে জাদুঘরের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, উপকমিটির সুপারিশমালা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে যাবে। তখন সেখানে যা হয় পরে জানা যাবে। বালু-সিমেন্ট বনাম আগ্নেয় শিলা: সম্প্রতি উপপরিচালক মনিরুল হকের বিরুদ্ধে জাদুঘরের একটি বুদ্ধমূর্তির একটি হাত ভেঙে ফেলার অভিযোগ ওঠে। তিনি কৈফিয়ত দিতে গিয়ে নিজেকে বিশেষজ্ঞ দাবি করে বলেছেন, মূর্তিটি বালু ও সিমেন্টের তৈরি। এর কোনো প্রত্ন বা শৈল্পিক মূল্য নেই। এটি জাদুঘরে গ্রহণের অযোগ্য। এ বিষয়টি যাচাই করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের তিনজন শিক্ষককে দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। তাঁরা ৭ ডিসেম্বর একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এতে বলা হয়েছে, বালু-সিমেন্টের নয়, বুদ্ধমূর্তিটি কালো বর্ণের পাতালিক আগ্নেয় শিলার তৈরি। ভেঙে ফেলার বিষয়টি দুরভিসন্ধিমূলক। মনিরুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার চোখে সমস্যা থাকার কারণে বুঝতে পারিনি মূর্তিটি কিসের। পরে বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটির কাছে দুঃখ প্রকাশ করে চিঠি দিয়েছি।’

No comments:

Post a Comment