Monday, December 15, 2014

ছড়িয়ে পড়া সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েলের ১৮ হাজার অপসারণ:নয়াদিগন্ত

সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ডুবে যাওয়া তেলবাহী ট্যাংকার থেকে ছড়িয়ে পড়া সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস ওয়েলের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৮ হাজার লিটার অপসারণ করা হয়েছে। বন বিভাগ এ তথ্য জানিয়েছে।  সুন্দরবনকে বাঁচাতে এখন অয়েল সুইপার জলযান আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) খুলনার সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল। এ দিকে ডুবে যাওয়া তেলবাহী ট্যাংকার চালক (মাস্টার) মোকছেদ মাতুব্বরের (৫৭) লাশ গতকাল সকালে
উদ্ধার করা হয়েছে।  অপর দিকে অয়েল ট্যাংকার ডুবির পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অবৈধভাবে চলা শ্যালা নদীর চ্যানেলটি। এতে মংলা বন্দরে আটকা পড়েছে দুই শতাধিক লাইটারেজ জলযান। ফলে সারা দেশের সাথে মংলা বন্দরের নৌ যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মংলা বন্দরে অবস্থানরত ১১টি জাহাজে পণ্য উঠানো নামানোর কাজ ব্যাহত হচ্ছে। দুর্ঘটনার পাঁচ দিন অতিবাহিত হলেও দায়ী ট্যাংকারের মালিক বা কোনো কর্মকর্তাকে এখনো গ্রেফতার করা হয়নি। ফলে সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের মধ্যে তীব্র ােভের সৃষ্টি হয়েছে। সুন্দরবনের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংগঠন প্রতিদিনই দোষী ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে শাস্তির দাবি জানিয়ে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন করছেন।  পাঁচ দিন পর ট্যাংকার চালকের লাশ উদ্ধার : শ্যালা নদীতে ডুবে যাওয়া তেলবাহী ট্যাংকার চালক (মাস্টার) মোকছেদ মাতুব্বরের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ট্যাংকার ডুবির পাঁচ দিন পর গতকাল সকালে শ্যালা নদীর মৃগমারী এলাকা থেকে মোকছেদের লাশ উদ্ধার করে তার স্বজনেরা। তার বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপাশা গ্রামে। বাবার নাম ইজ্জত আলী হাওলাদার।  মোকছেদের লাশ উদ্ধার করেন তার মেয়ের জামাই শহীদুল ইসলাম। তিনি জানান, ট্যাংকার ডুবির পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন মোকছেদ। তাকে খুঁজে পেতে তিন-চারটি ট্রলার নিয়ে স্বজনেরা শ্যালা নদীর আশপাশে সন্ধান চালান। গতকাল ভোর সাড়ে ৬টার দিকে মৃগমারী এলাকার বাদামতলী খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।  এ ব্যাপারে জয়মনি চাঁদপাই নৌপুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মো: নজরুল ইসলাম বলেন, সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ বাগেরহাট সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।  দেশীয় পদ্ধতিতে চলছে তেল অপসারণ : সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ডুবে যাওয়া তেলবাহী ট্যাংকার থেকে ছড়িয়ে পড়া সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েলের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৮ হাজার লিটার অপসারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। খুলনার বিভাগীয় বনকর্মকর্তা আমির হোসেন চৌধুরী বলেন, রোববার সকাল পর্যন্ত স্থানীয় জেলে ও বন বিভাগের নিয়োগ করা শ্রমিকেরা এ তেল সংগ্রহ করে পদ্মা অয়েল কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থায় বন বিভাগ নদীতে ভাসমান ও পাড়ে জমে থাকা তেল অপসারণের দিকে নজর দিচ্ছে। গাছপালা বা ঝোপঝাড়ে লেগে থাকা তেল অপসারণ এ মুহূর্তে সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি। স্থানীয় জেলেরা জানান, তারা নদীর পাড়ে বেশ কিছু মৃত কাঁকড়া দেখতে পেয়েছেন। বন বিভাগ কর্মকর্তা আমির হোসেন চৌধুরী বলেন, ডলফিন বা অন্য প্রাণীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার লণ তারা এখনো দেখেননি। তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির পর সেখানে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়া তেল পরিষ্কার করতে বন বিভাগ অভিযান জোরদার করেছে। শনিবার থেকে প্রায় ২০০ লোককে নদী থেকে তেল ছেঁকে তোলার কাজে লাগানো হয়েছে। সর্বশেষ ১০০ নৌকা ও ৩০০ কর্মী তেল সংগ্রহ করছেন। সরকারের বনকর্মকর্তারা এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে সুন্দরবনের তিগ্রস্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছেন। সুন্দরবনের ইতিহাসে এটি এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সুন্দরবন বাঁচাতে চাই অয়েল সুইপার : পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না পাওয়ায় সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া কালো ফার্নেস তেল অপসারণে কাজ করতে পারছে না কাণ্ডারি-১০। তবে এতে যে পরিমাণ কেমিক্যাল আছে তাতে মাত্র এক ভাগ তেল ডুবিয়ে দেয়া সম্ভব। কিন্তু তাতে রয়েছে পরিবেশবিদদের আপত্তি। তাই সুন্দরবনকে বাঁচাতে এখনই প্রয়োজন অয়েল সুইপার জলযান। এমনটি মনে করেন বেলার খুলনার সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল। তিনি বলেন, নদী, সমুদ্র বা জলাভূমি থেকে ভাসমান তেল দ্রুত চুষে নিতে সম এ অয়েল সুইপার জলযান রয়েছে এশিয়ার অনেক দেশে। সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া বা আরব আমিরাত সরকারের সাহায্য নিয়ে সেখান থেকে দ্রুত অয়েল সুইপার জলযান আনা প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, সুন্দরবনকে রা করা এখন বাংলাদেশের জন্য চ্যলেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অয়েল সুইপার জলযান আনা হলে দ্রুতই রা করা সম্ভব হবে সুন্দরবনকে। দেখা মিলছে না ডলফিনের : কয়েক বছর আগেও প্রাণিবিজ্ঞানীদের কাছে ইরাবতী ছিল হারিয়ে যাওয়া ডলফিন। বিশ্বের সবাই জানত ইরাবতী ডলফিন পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের একদল প্রাণিবিজ্ঞানী কয়েক বছর আগে সুন্দরবনসহ উপকূলে খুঁজে পান দুর্লভ ওই ডলফিনসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন। হারিয়ে যাওয়া ডলফিন ইরাবতীর সন্ধান মিলেছে সুন্দরবনে এ খবরে তখন বিশ্বে আলোড়ন তোলে। গত ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ফার্নেস অয়েল বোঝাই ট্যাংকার ডুবির পর তেল ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ওই দিন সকাল থেকেই শ্যালা নদীতে ডলফিনের অভয়াশ্রমে আর দেখা মিলছে না ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিনের। সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, ইরাবতীসহ সুন্দরবনের ছয় প্রজাতির ডলফিন খুবই স্পর্শকাতর। তারা যখন বুঝেছে তাদের অভায়াশ্রম আক্রান্ত হয়েছে তারা দ্রুতই স্থান ত্যাগ করেছে এমনটিই মনে হচ্ছে। গত পাঁচ দিনে শ্যালা নদীসহ আশপাশের কোথাও কেউ ডলফিনের দেখা পাননি। সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ায় ডলফিন যদি সুন্দরবন ত্যাগ করে তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তিনি আরো বলেন, সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে ৪৪৪টি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মধ্যে ৬৩টির বাস শ্যালা নদী এলাকায়। এ রয়েল বেঙ্গল টাইগারেরও দেখা মিলছে না। আমাদের এ সম্পদ হারানোর জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সহ যারাই দায়ী তাদের একদিন জাতির কাছে জবাবদিহি করতে হবে। শ্যালা নদীতে মৃত ডলফিন : শনিবার সুন্দরবনের শ্যালা নদীর একটি চ্যানেলে ইরাবতী ডলফিনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যেই শুশুকসহ বিভিন্ন প্রাণীর মৃত দেহ পাওয়া গেলেও এবার ডলফিন পাওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে। সংরতি এলাকায় তেলের কারণে মারা গেছে ডলফিনটি। প্রত্যদর্শী বিষয়টি নিশ্চিত করলেও কোনো বনকর্মকর্তা স্বীকার করেননি।  মংলায় আটকা দুই শতাধিক লাইটারেজ জাহাজ : সুন্দরবনের অয়েল ট্যাংকার ডুবির পর বন্ধ করে দেয়া হয় অবৈধভাবে চলা শ্যালা নদীর চ্যানেলটি। ফলে মংলা বন্দরে আটকা পড়েছে দুই শতাধিক লাইটারেজ জলযান। এসব জলযানের মাস্টার ও ক্রুরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সারা দেশের সাথে মংলা বন্দরের নৌযোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মংলা বন্দরে অবস্থানরত ১১টি জাহাজে পণ্য উঠানো-নামানোর কাজ ব্যাহত হচ্ছে। মংলা বন্দর হারবার মাস্টার খান মো: আখতারুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেন। ফের সুন্দরবনের ভেতরে নৌরুট : সুন্দরবনের শ্যালা নদীর ভেতর দিয়ে চলা অবৈধ নৌরুটে অয়েল ট্যাংকার ডুবির পর ওই রুটটি বন্ধ করে দেয় বিআইডব্লিউটিএ। অয়েল ট্যাংকার ডুবে সুন্দরবনের ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ায় বিপর্যয়ে পড়েছে সুন্দরবন। এ অবস্থার মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ সুন্দরবনের সুপতি-কচিখালী নদী দিয়ে নতুন করে নৌযান চলাচলের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। সুন্দরবনের তেল অপসারণে নৌবহর : সুন্দরবনের শ্যালা নদী এবং আশপাশের খালে ছড়িয়ে পড়া তেল অপসারণে ১০০ নৌকা ও ৩০০ কর্মী তেল সংগ্রহ করছে। শনিবার সকাল থেকে নৌকার পাশাপাশি কিছু ট্রলারও কাজে লাগানো হলেও তা এখন বাড়ানো হয়েছে।  চাঁদপাই বনফাঁড়ির সহকারী বন সংরক আবুল কালাম আজাদ বলেন, তেল অপসারণে ১০০ নৌকা ও ৩০০ কর্মী তেল সংগ্রহের কাজে লাগানো হয়েছে। বন বিভাগের বোটম্যান নুরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে তেল অপসারণে সকাল থেকে কাজ চলছে। নদী ছাড়াও সুন্দরবনের ভেতরে ছোট ছোট খালে অভিযান চালানো হচ্ছে। বন বিভাগের এই উদ্যোগের সাথে স্থানীয় লোকজনও সহযোগিতা করছেন। তারা সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় তেল সংগ্রহে সহযোগিতা করছেন। খুলনা অঞ্চলের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা আমির হোসেন চৌধুরী জানিয়েছেন, শ্রমিকেরা চিকনঘন জাল দিয়ে ছেঁকে ছেঁকে ভাসা তেল তুলছেন। একই সাথে তেলে লেপ্টে যাওয়া কচুরিপানাসহ অন্যান্য জলজ উদ্ভিদও তুলে আনা হচ্ছে। সুন্দরবনের তেল অপসারণে নৌবহর স্থানীয়ভাবে বিষয়টি নজরে এলেও এখন পর্যন্ত মাছ বা ডলফিনসহ অন্য কোনো জলজ প্রাণীর মরে ভেসে ওঠার কোনো লণ চোখে পড়েনি বন বিভাগের কর্মকর্তাদের। তবে কর্মকর্তারা নদী ও খালের তীরে কাদার ভেতরে মরা কাঁকড়া দেখা যাচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন। ট্যাংকার মালিক গ্রেফতার না হওয়ায় ােভ : সুন্দরবনে তেল-দুর্ঘটনার পর বাদাবনের পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি। দুর্ঘটনার পাঁচ দিন পার হয়ে গেলেও দায়ী ট্যাংকারের মালিক বা কোনো কর্মকর্তাকে এখনো গ্রেফতার করা হয়নি। বারসিক, উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (কিন), গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান (সিএসআরএল), জনউদ্যোগ ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) যৌথ আয়োজনে নগরীর পিকচার প্যালেস মোড়ে মানববন্ধনে বক্তারা ােভ প্রকাশ করে এ কথা বলেন। মানববন্ধনে বক্তৃতা করেন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, জন উদ্যোগ খুলনার আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা, অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম, কিনের প্রধান সঞ্চালক হাসান মেহেদী, পবার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, অধ্যাপক শেখ সাদী ভূঁইয়া, শ্যামল সিংহ রায়, মহিউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ আলী হাকিম, আফজাল হোসেন রাজু, এস এম সোহরাব হোসেন, অ্যাডভোকেট মামুনর রশীদ, জগন্নাথ দত্ত, মাসুম বিল্লাহ, কারি শরিফ মিজানুর রহমান, মাস্টার বদিয়ার রহমান ও আজিজুর রহমান প্রমুখ। 

No comments:

Post a Comment