Monday, December 15, 2014

কোন্দলে বিপর্যস্ত তৃণমূল আ’লীগ:নয়াদিগন্ত

তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সম্মেলন ঘিরে চাঙ্গা হওয়ার পরিবর্তে তৃণমূল নেতাকর্মীরা জড়িয়ে পড়ছেন সংঘর্ষে। নিজ দলের কর্মীদের খুন করতেও দ্বিধাবোধ করছেন না তারা। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, খুনাখুনি, রেশারেশি-সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ায় বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকার পতন আন্দোলন ঠেকানোর প্রস্তুতি নিয়েও ভাবিয়ে তুলেছে আওয়ামী লীগকে। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে দেশের বেশির ভাগ জেলা-উপজে
লায় বিএনপি-জামায়াত জোটকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। সামনের আন্দোলন মাথায় রেখেই তৃণমূলকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সম্মেলন শেষ করতে চাইলেও তৃণমূলের এই অস্থিরতায় দলের হাইকমান্ডকে নতুন করে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ নয়া দিগন্তকে জানান, সিলেটের পাঁচটি সাংগঠনিক জেলার বেশির ভাগ উপজেলায় সম্মেলনের কাজ শেষ হয়েছে। কয়েকটি উপজেলায় সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা আছে। খুব শিগগিরই সব উপজেলা সম্মেলনের কাজ শেষ করা হবে। তিনি বলেন, বিশাল রাজনৈতিক দল হিসেবে ছোটখাটো কিছু সমস্যা তো থাকবেই। কাউন্সিল ঘিরে নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করছে। নেতৃত্ব নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে। পদের সংখ্যা সীমিত, প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক। সে জন্য যারা পদে আসতে পারছেন না তারা মূলত বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জায়গায় বিশৃঙ্খলা করছেন।  সম্প্রতি আড়াইহাজারের কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আম্বর আলী ও আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ ও গুলিবিনিময় হয়। এর আগে গত ২১ নভেম্বর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কুমিল্লার তিতাস উপজেলার কলাকান্দি ইউনিয়ন সভাপতি হাবিব উল্লাহ বাহার ও সাবেক সভাপতি ইব্রাহিম গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রেজাউল করিম সেন্টু নামে ক্ষমতাসীন দলের এক কর্মী নিহত হন। গত ২২ নভেম্বর গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপ পাল্টাপাল্টি জনসভার ডাক দেয়ায় সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে গত ২০ নভেম্বর ময়মনসিংহের নান্দাইলে সাবেক এমপি মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুস সালাম ও আনোয়ারুল আবেদীন তুহিন গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আবুল মনসুর ভূইয়া নামে আওয়ামী লীগের এক কর্মী নিহত হন। দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই দুইটি গ্রুপের কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। গত ২৮ নভেম্বর রাতে শেরপুরের ঝিনাইগাতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বিবদমান দু’গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের এক দিন পর গত ২৭ নভেম্বর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে চাপাইন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সারোয়ার হোসেন ও একই ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল আমিন রানার মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এ নিয়ে সড়ক অবরোধও করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। একই দিনে ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির ১২টি শূন্যপদ পূরণকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে টানা তিন দিন উভয়পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময়, ককটেল বিস্ফোরণ, বাসাবাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর হয়। বর্তমানে এই জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে বিভক্তি ও কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।  গত ৪ ডিসেম্বর রাতে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ভারপ্রাপ্ত জেলা সভাপতি মতিউর রহমানের বাসভবনে হট্টগোল দেখা দেয়। একপর্যায়ে সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনকে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়। একই সময় ছাতক উপজেলার কমিটি গঠন নিয়ে স্থানীয় এমপি মুহিবুর রহমান মানিক ও ছাতক পৌরমেয়র আবুল কালাম চৌধুরীর সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। এর আগে গত ১০ নভেম্বর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সিরাজদিখান উপজেলায় বালুরচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আলেক চান মুন্সী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য নুরু বাউলের গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় পাঁচটি গ্রামের শতাধিক বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় বলে জানা গেছে। গত ১১ নভেম্বর শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আব্দুল্লাহ সালেহ ও যুগ্ম আহ্বায়ক মোতাহারুল ইসলাম লিটনের গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। গত ১৪ নভেম্বর পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংর্ঘষ হয়। একই দিনে রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা দেখা দেয়। উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তসিকুল ইসলাম পররাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বিপক্ষে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হওয়ায় কৌশলে তাকে গ্রেফতার করানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তসিকুল ইসলামের বড় ভাই বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা আলতাব হোসেন সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, সামনের কাউন্সিলে ছোট ভাই পররাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের এমপি শাহরিয়ার আলমের প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।  গত ১৫ নভেম্বর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মামুনুর রশিদ কিরণের সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। গত ১৬ নভেম্বর মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার রামনগর মোনাখালী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমিটি গঠন উপলক্ষে সম্মেলন শুরু হলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মোল্লা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের আরেক নেতা আতাউর রহমানের গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় কাউন্সিল বন্ধ করে দেয়া হয়। গত ১৮ নভেম্বর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুল ও শ্রমিক লীগ নেতা সানোয়ার হোসেন সানের গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ ঘটনায় অন্তত ১০ নেতাকর্মী আহত হন। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে গত ১১ নভেম্বর ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার পরমেশ্বরদী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। গত ৩০ অক্টোবর কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জের ১২টি ইউনিয়নের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক নাসিরুল ইসলাম খান আওলাদ ও ইউপি চেয়ারম্যান জেলা শ্রমিক লীগ সভাপতি এ বি এম সিরাজুল ইসলামের মধ্যে দীর্ঘ দিনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। সম্মেলনকে ঘিরে তারা পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করে।  আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নয়া দিগন্তকে বলেন, একেক জায়গায় একেক রকম ইস্যু নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে এটা ঠিক। তবে যারা সংঘর্ষ বাধাচ্ছে ওই সব নেতাকর্মী হলো মওসুমি পাখির মতো। যে দলই ক্ষমতায় থাকে তারা ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে ঢুকে দলকে বিপদে ফেলার জন্য অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে। অ্যাডভোকেট হুমায়ুন বলেন, যেসব এলাকায় সংঘর্ষ হচ্ছে ওখানকার স্থানীয় নেতারা যদি তাদের বিষয়ে অভিযোগ করে তাহলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

No comments:

Post a Comment