Tuesday, December 16, 2014

‘জয় বাংলা’ বলে কুশল বিনিময়:প্রথম অালো

তখনো গোটা দেশ শত্রুমুক্ত হয়নি। থেমে থেমে তুমুল যুদ্ধ চলছে দেশজুড়ে। চূড়ান্ত বিজয়ের ২৪ দিন আগেই মুক্ত হলো যশোরের চৌগাছা। ‘জয় বাংলা’ বলে কুশল বিনিময় করছে তখন এ অঞ্চলের মানুষ।  ২২ নভেম্বর চৌগাছার জগন্নাথপুর গ্রামে তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানি শত্রুরা পরাজিত হয়ে পিছু হটতে থাকে। সলুয়া ও জগন্নাথপুরসহ আশপাশের গ্রামে অবস্থান নেওয়া পাকিস্তানি বাহিনী ধীরে ধীরে গুটিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আনন্দের জোয়ার
ে ভাসছে গোটা চৌগাছা। চৌগাছা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা আমিরুল আলম খান বললেন, কার্যত ২২ নভেম্বরই চৌগাছা শত্রুমুক্ত হয়। দেশ স্বাধীন হয় ১৬ ডিসেম্বর। মাঝখানের এ সময়ের মধ্যে চৌগাছা এলাকায় সরকারি কোনো প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তবুও লুটপাট বা কোনো উচ্ছৃঙ্খল ঘটনা ঘটেনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত চৌগাছার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাই। আমিরুল আলম খানের কপোতাক্ষ-মধুমতীর তীর থেকে গ্রন্থে রয়েছে, ‘একাত্তরের ২১ নভেম্বর ঈদের দিন। বিকেল তিনটা। উত্তর দিকে ভীষণ গর্জন। ভারতীয় ট্যাংক সার বেঁধে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের চৌগাছা সেক্টর অভিমুখে। রাতেই ট্যাংকগুলো শুরু করে অবিশ্রান্ত গোলাবর্ষণ। পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান জগন্নাথপুর ও তার আশপাশের গ্রামে, সামরিক মানচিত্রের ভাষায় গরিবপুর। ২২ নভেম্বর দিন-রাত ভয়াবহ যুদ্ধ চলে। চৌগাছা ফ্রন্টে এই লড়াইটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তীব্র ও ভয়াবহ।’ মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান কবীর বলেন, মানুষ গ্রামে ফিরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগানে স্লোগানে গোটা এলাকা মুখর করে তোলেন। ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা যমুনা’ আর ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি সবখানে। মানুষ তখন রাস্তায় নেমে উল্লাস করতে থাকে। দেখা হলে একে অন্যের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ বলে কুশল বিনিময় করত সবাই। যুদ্ধের সময় মাঠজুড়ে হেমন্তের সোনারং ধান আর সরিষা। আর কদিন পরেই কাটা পড়বে সে ধান। সবার মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক, কী হবে শুকনো মৌসুমে? মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেন, তাঁদেরই একজন হয়ে। তাঁরা আশ্রয়দাতাদের আশ্বস্ত করতেন এই বলে যে ‘শুকনো মৌসুম আসার আগেই স্বাধীন হয়ে যাবে দেশ।’ চৌগাছা উপজেলার ফুলসরা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ৮১ বছর বয়সের মোকাররম হোসেন বলেন, ‘একাত্তরে যুদ্ধের সময় বাড়িঘর ফেলে আমরা গ্রামে গ্রামে পালিয়ে বেড়াতাম। ২২ নভেম্বর বড় যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী এলাকা ছাড়লে গরু-বাছুর নিয়ে আবার আমরা আস্তে বাড়িঘরে ফিরতে থাকি। তখন খেতে ধান-সরিষা তেমন কিছুই নেই। সাঁজোয়া যান আর দিগ্ভ্রান্ত মানুষের পায়ের তলায় প্রায়ই সবই পিষ্ট হয়েছে। ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত। গ্রামে ফিরে ঘরদরজা ঠিকঠাক করতে থাকি। ঘরে শালকেলে ধানের বীজ ছিল। কোনো রকমে জমিজমা চাষ দিয়ে ওই ধানের বীজ খেতে বুনে দিই।’ সত্তর বছর বয়সী আতিয়ার রহমান ঢালী বলেন, ‘যুদ্ধের শেষ দিকে পাঞ্জাবিরা যখন চৌগাছা এলাকায় ঘাঁটি গাড়ল, তখন আমরা ফুলসরার পার্শ্ববর্তী চার গ্রামে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতাম। পাঞ্জাবিরা চলে গেলে আস্তে আস্তে ফিরে বাড়িতে উঠলাম। তবুও ভয় থাকল। মুক্তিযোদ্ধারা সাহস দিতেন। আস্তে আস্তে ভয় কাটতে থাকল।’

No comments:

Post a Comment