Saturday, December 13, 2014

আগাম সবজিতে সর্বস্বান্ত কৃষক:কালের কন্ঠ

আগাম চাষে বেশি যত্ন নিতে হয়, তাই খরচও হয় বেশি। মৌসুমের শুরুতে শীতের সবজি বাজারে এলে ভালো দাম পাওয়া যায়। তাই বাড়তি খরচ করে আগাম চাষে কৃষকের অনাগ্রহ তো থাকেই না, বরং আগ
্রহই থাকে বেশি। কিন্তু এবার আগাম সবজি চাষ করে ‘মারা পড়েছে’ কৃষক। ১৫ দিন আগে থেকে ঢাকাসহ দেশের সবজিপ্রধান জেলাগুলোতে শীতের সবজির দাম মারাত্মকভাবে কমে গেছে। ফলে কৃষক সবজি বেচে দাম পাচ্ছে উৎপাদন খরচের চেয়েও কম। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, একটু ভালো মুনাফার আশায় কৃষক এবার আগাম সবজি চাষ করেছিল বেশি। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় ফলনও হয়েছে বেশি। তাই হাট-বাজারে একসঙ্গে বিপুল সবজির আমদানি হওয়ায় দাম গেছে পড়ে। আর কৃষক পড়েছে বিপাকে। ঢাকার আড়তদাররা বলছে, প্রতিবছর শীতের মাঝামাঝিতে গিয়ে সবজির দাম কমে যায়। কৃষকরা মৌসুমের শুরুতে ভালো দামে ওই সব সবজি বিক্রি করতে পারে। ফলে গড়পড়তায় তাদের ভালো লাভ থাকে। এবার ঢাকায় শীত জাঁকিয়ে বসার আগেই শীতের সবজির সরবরাহ ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। ফলে প্রায় ১৫ দিন আগে থেকে কমতে কমতে এখন তলানিতে ঠেকেছে সবজির দাম। কারওয়ান বাজারের আড়ত মালিক মোশারফ হোসেনের কাছে এবারের অভিজ্ঞতাটা নতুন। তিনি বলেন, এবার সবাই আগাম সবজি বাজারে আনার চেষ্টা করেছে। সবাই মনে করেছে ভালো দাম পাবে। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘চাষিরা শেষ; প্রত্যেক চাষি লোকসানে।’ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, প্রতিবছর শীত মৌসুমে বাংলাদেশে চার লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ হয়। এতে উৎপাদন হয় প্রায় ১৭ লাখ টন সবজি। শীতের শুরুতে মুলা, শালগম, ফুলকপি, বাঁধাকপির দিকে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ থাকে। ফলে প্রথম দিকে প্রতিটি ছোট আকারের ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৪০-৫০ টাকা, মুলা প্রতি কেজি ৪০-৫০ টাকা, শালগম ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। ১০০ টাকার বেশি দাম দিয়ে শিম ও ৮০ টাকা কেজি দরে নতুন আলু কিনতেও আগ্রহ দেখা যায় ক্রেতাদের মধ্যে। দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকার বাজারে প্রতিটি ফুলকপি ২০-২৫, বাঁধাকপি ২০-২৫, মুলা ১৫-২০ ও শালগম ২০-২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। অবশ্য কৃষক পর্যায়ে দাম একেবারেই কম। রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহের বিভিন্ন পাইকারি বাজার ঘুরে কালের কণ্ঠের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, সেখানকার বাজারে প্রতিকেজি মুলা ২৫ পয়সা থেকে এক টাকা, শালগম ২-৩, ফুলকপি প্রতিটি ৩-৫ ও বাঁধাকপি ৩-৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এবার শীতের শুরুতে সবজির দাম বেশি ছিল না, তা নয়। তবে সেই বাড়তি দাম স্থায়ী ছিল অল্প কয়েক দিন। সপ্তাহ দুয়েক আগে হঠাৎ করেই সেই দামে বড় ধস নামে। কারওয়ান বাজারের আড়তকর্মী খলিলুর রহমান জানান, এবার শীতের সবজির মোটামুটি সরবরাহ শুরু হয়েছিল এক মাস আগে থেকে। তখন দাম ভালো ছিল। কিন্তু ১৫ দিন আগে থেকে এর সরবরাহ অনেক বেড়ে গিয়ে দাম কমে গেছে। একই কথা জানান আড়তকর্মী হানিফ মিয়া ও ফড়িয়া ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম। হানিফ মিয়ার মতে, এবার শীতের আগে আবহাওয়া ভালো ছিল। বড় ধরনের বৃষ্টিপাত হয়নি বলে ফুলকপি, বাঁধাকপির ফলন ভালো হয়েছে। সব একসঙ্গে বাজারে আসায় দাম কমে গেছে। আড়তকর্মী খলিলুর রহমান বলেন, গত বছরও সবজিচাষিরা ধরা খেয়েছিল। তখন কারণ ছিল টানা হরতাল-অবরোধ। যে সবজি ঢাকায় আসতে পেরেছিল তা চড়া দামে বিক্রি হয়েছিল। অবশ্য খুব কমসংখ্যক ট্রাক তখন ঢাকায় এসেছিল। ফলে কৃষক সবজি চাষ করে লোকসান দিয়েছিল। উৎপাদন খরচও জুটছে না : শীতকালীন সবজির উৎপাদন খরচ কত তার হালনাগাদ হিসাব কোনো সরকারি সংস্থার কাছে নেই। কৃষকরা প্রতিটি খাত ধরে ধরে সূক্ষ্মভাবে সেই হিসাব করে না। তবে মোটা দাগে প্রত্যেকের কাছেই খরচের একটি হিসাব থাকে। সেই হিসাব বলছে, এখন সবজি বিক্রি করে কৃষকের উৎপাদন খরচও উঠছে না। রাজশাহীর পবা ইউনিয়নের পারিলা গ্রামের কৃষক ইয়াকুব আলী এ বছর ১২ কাঠা জমিতে শীতকালীন ফুলকপির চাষ করেছেন। এতে তাঁর খরচ হয়েছে সাড়ে ১১ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত তিনি ওই জমি থেকে তিন হাজার টাকার ফুলকপি বিক্রি করেছেন। জমিতে আরো যে পরিমাণ ফুলকপি আছে তা বর্তমান বাজার দরে বিক্রি করলে তাঁর খরচ উঠবে না। ফলে তিনি জমি থেকে ফুলকপি আর তুলছেন না বলে জানান। সরাসরি সাভারের একজন কৃষকের কাছ থেকে গত বুধবার শালগম কিনে কারওয়ান বাজারে এনেছেন ফড়িয়া নুরুল ইসলাম। গত বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজারে সেই শালগম তিনি বিক্রি করছেন পাইকারি কেজিপ্রতি ৭-১০ টাকা দরে। নুরুল ইসলাম জানান, প্রতিকেজি শালগম তিনি তিন টাকা কেজি দরে কিনেছেন। পরিবহন ও শ্রমিকদের খরচ বাদ দিয়ে প্রতিকেজিতে তাঁর লাভ হচ্ছে ২-৩ টাকা। কৃষকের লাভ কত জানতে চাইলে তাঁর সহজ স্বীকারোক্তি, ওই শালগম উৎপাদনে কৃষকের প্রতিকেজিতে কমপক্ষে পাঁচ টাকা খরচ হয়েছে। তিন টাকা কেজি দরে বিক্রি করায় কৃষকের লোকসান হয়েছে কেজিতে দুই টাকা। রংপুর জেলার বলদিপুকুর ইউনিয়নের বাড়ইপাড়া এলাকার কৃষক কোনা মোহন্ত এবার দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি ও বাঁধাকপির চাষ করেছেন। জমি তৈরিসহ বীজ, সার, কীটনাশকে খরচ হয়েছে বিঘাপ্রতি ১৫ হাজার টাকা। তিনি জানান, আশা ছিল প্রতিটি কপি ১৫ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি করবেন। কিন্তু বাজারে মহাজনরা দাম দিচ্ছেন মাত্র পাঁচ টাকা করে। একই এলাকার কৃষক শাহাদাত হোসেন বলেন, এক বিঘা জমির মুলা ৫০০ টাকায়ও বিক্রি করা যাচ্ছে না। ঢাকায় দাম বাড়াচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা : সবজির সরবরাহ শৃঙ্খল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি দাম বাড়ান খুচরা ব্যবসায়ীরা। ঢাকার আড়ত থেকে তাঁরা যে দরে সবজি কেনেন তাঁর দ্বিগুণ-তিন গুণ দামে খুচরা বাজারে বিক্রি করেন। অল্প পরিমাণ সবজি বিক্রি করে তাঁরা বেশি পরিমাণ আয় করতে চান বলেই দাম বেশি হয়ে যায়। গত বুধবার রাত ও বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকার কারওয়ান বাজারের আড়তে প্রতিকেজি মুলা ৩-৬, শালগম ৬-৭, ফুলকপি প্রতিটি ৮-১০ টাকা ও বাঁধাকপি ৭-৮ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। সকালে কারওয়ান বাজারের আড়তের পাশে খুচরা দোকানে প্রতিকেজি মুলা ১৫-২০, শালগম ২০, ফুলকপি প্রতিটি ২০-২৫ ও বাঁধাকপি ২০ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা যায়। অন্যান্য খুচরা বাজারে দাম আরেকটু বেশি। বৃহস্পতিবার সকালে মহাখালী ও কাজীপাড়া বাজারে মুলা ২০-২৫, ফুলকপি ২০-৩০, বাঁধাকপি ২০-২৫ ও শালগম ২০-২৫ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা যায়। কাজীপাড়ার খুচরা বিক্রেতা মো. কাজল জানান, প্রতিদিন তাঁরা প্রায় ৪০০ কেজি সবজি কেনেন। মাসে দোকান ও কর্মচারী মিলিয়ে তাঁদের খরচ ৫০ হাজার টাকা। এ টাকাটা তাঁদের ওই পরিমাণ সবজি বিক্রি করেই ওঠাতে হয়। এ প্রতিবেদনটি লিখতে কালের কণ্ঠের রাজশাহী ব্যুরোর প্রতিবেদক রফিকুল ইসলাম ও রংপুর প্রতিনিধি স্বপন চৌধুরী সহায়তা করেছেন।

No comments:

Post a Comment