Saturday, December 13, 2014

কেউ খোঁজ নেয় না:কালের কন্ঠ

'আমার মরে যাওয়া ভালো ছিল। বাচ্চারা জানত বাবা নেই। কিছু চাইত না। এখন আমি নিজেই সংসারের বোঝা। না কাজ করতে পারি, না কারো কাছে হাত পাততে পারি।' গত জাতীয় নির্বাচনের আগে বি
রোধী দলগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সহিংসতার শিকার মো. হারুনুর রশীদের চোখের পানির সঙ্গেই ঝরে পড়ছিল অক্ষমতার আক্ষেপগুলো। জামায়াতের হরতালে আধপোড়া হয়ে আজও তিনি ধুঁকছেন। হারুন সিলেটের পীরেরবাজার চৌধুরীপাড়া এলাকার বাসিন্দা। প্রাইভেট কার চালাতেন ময়মনসিংহে। একটি ফোন কম্পানির কর্মকর্তাদের আনা-নেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁর। গত বছর ১০ ডিসেম্বর জামায়াতের ডাকা হরতাল ছিল। আগের দিন সন্ধ্যায় ফোন কম্পানির এক কর্মকর্তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে গ্যারেজে যাচ্ছিলেন। ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের সামনে যেতেই জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ইট মেরে গাড়ির কাচ ভেঙে দেয়। ভাঙা কাচের ফাঁক গলিয়ে পেট্রলবোমা গাড়ির ভেতরে ছুড়ে দিয়ে দূরে সরে যায় তারা। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে গাড়িটি। গাড়ি থেকে নামতে নামতে হারুনের ডান কান, পিঠ ও মুখ ঝলসে যায়। এরপর তাঁকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিক্যালে। চিকিৎসায় তাঁর কিছুটা উন্নতি হলেও ডান কানটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। যে কারণে তাঁকে কেউ কাজ দেয় না। দুই মাস পর পর তাঁর চিকিৎসার জন্য লাগে সাত-আট হাজার টাকা। টাকার অভাবে চিকিৎসা বন্ধ। স্যানিটারি ব্যবসায়ী আবু তালহা এক বছর আগেও বেশ সচ্ছল ছিলেন। তবে গত বছর ২৮ নভেম্বর শাহবাগে পেট্রলবোমায় পুড়ে এখন ঋণে জর্জরিত। ব্যবসা বসে গেছে। এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন। প্রতি মাসে তিন-চার হাজার টাকার ওষুধ লাগে। ঋণ, সংসার, সন্তানদের পড়াশোনা আর চিকিৎসা খরচ মিলিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন এ ব্যবসায়ী। জানালেন, তিনি আগের মতো চলাফেরা করতে পারেন না। প্রতি মাসে দগ্ধ স্থানে মাখার জন্য চার-পাঁচটা মলমের কৌটা লাগে। একেকটি কৌটার দাম ৮৭০ টাকা। সেই ক্ষত এখনো দেহজুড়ে রাজমিস্ত্রি আবুল কালাম পুড়েছিলেন গত বছর ১২ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার পথে। এখনো সুস্থ নন, শরীরও সায় দেয় না তবু কাজ করতে বের হতে হয়। যা উপার্জন করেন, তা দিয়ে সংসার চলে না। আবুল কালাম কালের কণ্ঠকে জানান, বার্ন ইউনিটে ভর্তি থাকার সময় প্রধানমন্ত্রী তাঁদের দেখতে গিয়েছিলেন। ওই সময় আবুল কালাম সংসার চালানোর জন্য তাঁর বড় মেয়েকে সরকারি চাকরি দেওয়ার কথা বলেন। আশ্বাসও পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ইন্টারমিডিয়েট পাস মেয়ে আজও বেকার। হারুন, তালহা বা কালামরা অবশ্য ভাগ্যবান। প্রাণ যায়নি তাঁদের। তবে ক্যান্টনমেন্টের বালুঘাট এলাকার ফল ব্যবসায়ী মো. ফরিদ মিয়াকে (৪০) নিয়তি এতটা ছাড় দেয়নি। এ বছরের ৩ জানুয়ারি পেট্রলবোমায় দগ্ধ ফরিদ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ৮ জানুয়ারি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। আর চরম বিপাকে ফেলে যান তাঁর পরিবারকে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আমজাদ হোসেন (বাঁয়ে); সহিংসতার ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন আজও। ফরিদ মিয়ার ছেলে স্বপনুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, বাবার ফল ব্যবসার আয় দিয়েই সংসার চলত। আশ্বাস থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য পাননি তাঁরা। তবে স্বপনকে এফবিসিসিআইয়ের তরফ থেকে লিফটম্যানের চাকরি দেওয়া হয়েছে। তাঁর ৯ হাজার টাকা বেতন দিয়েই এখন পুরো পরিবার চালাতে হচ্ছে। স্বপন বলেন, 'ছোট ভাই সুজন চতুর্থ ও লিটন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। এত অল্প টাকায় সংসার, ভাইদের পড়ালেখা চলছে না।' জামায়াত-শিবিরের পেট্রলবোমায় আহতদের প্রায় সবারই অবস্থা এমন। রাষ্ট্রের তরফ থেকে ৫০ হাজার টাকার মতো দিয়েই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। কেউ কেউ তাও পাননি। ভুক্তভোগীরা কালের কণ্ঠকে জানান, সে সময় সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল প্রত্যেকের পরিবারের দায়িত্ব নেবে সরকার। কিন্তু এখন কেউ তাঁদের খোঁজ নেয় না। এমনকি আত্মীয়স্বজনও সাহায্য করতে হতে পারে- এ ভয়ে দূরে সরে গেছে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যাঁরা সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তাঁরা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সরকারের উচিত বিনা পয়সায় চিকিৎসা করানো। আর যদি সুস্থ হয়ে থাকেন, তাহলে কাজ দিয়ে পুনর্বাসন করা দরকার রাষ্ট্রের। যদি কাজ করতে না পারেন, তাহলে তাঁর পরিবারের কাউকে চাকরি দিয়ে রাষ্ট্রের সহযোগিতা করা উচিত।' আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী রাজনৈতিক সহিংসতায় ২০১৩ সালে পুলিশ এবং বিজিবি সদস্যসহ ৫০৭ জন মারা যান। আহত হয়েছে ২২ হাজার মানুষ। দগ্ধদের প্রায় সবাইকেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ইউনিটের চিকিৎসক ডা. হোসাইন ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, গত বছর ১০৭ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন। এর মধ্যে ২৩ জন মারা গেছেন। বাকিরা চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের উপদেষ্টা ডা. সামন্তলাল সেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আগুনে শরীর পুড়লে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করাতে হয়। যাঁরা আহত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বর্তমানে চার-পাঁচজন চিকিৎসা নিতে আসেন।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'যাঁরা ওই সময় আহত হয়েছিলেন, তাঁদের চিকিৎসা বিনা পয়সায়ই করা হয়।' পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় মামলা হয়েছে তিন হাজার ৭০০-এর বেশি। এর মধ্যে গত জুলাই মাস পর্যন্ত অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে দুই হাজার মামলার। এক হাজার ৬০০ মামলা তদন্তাধীন। আর শতাধিক মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। আইন তৈরি করছে সরকার : সরকার ভিকটিম সাপোর্ট আইন তৈরি করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ভিকটিম ও তাদের পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য আইন রয়েছে। পাশের দেশ ভারত-পাকিস্তানেও এমন আইন রয়েছে। সেই আইনেই উল্লেখ রয়েছে, যারা সন্ত্রাসের শিকার হবে তাকে ও তার পরিবারকে কিভাবে আর্থিক সহযোগিতা করবে সরকার। বাংলাদেশেও এ ধরনের একটি আইনের খসড়া তৈরি করার চিন্তা করা হচ্ছে। এ আইনের ভিকটিমদের সহায়তা করার বিধান থাকবে। তাদের পরিবারের নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে আইনে উল্লেখ থাকবে।    

No comments:

Post a Comment