Sunday, July 20, 2014

সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুবের অবিশ্বাস্য সম্পদ স্ফীতি:যুগান্তর

সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের টান ছিল মাটির প্রতি। পানি থেকে আহরিত অর্থে কিনেছেন বিঘার পর বিঘা মাটি। ধানী জমি, জলাশয়, ভিটেবাড়ি, ঘাট, বসতি- চোখে যা পড়ত সবই তার চাই। পটুয়াখালীর লতাচাপালি, ধানখালী, বাদুড়তলী, ধুলাশ্বর, লেমুপাড়া, খেপুপাড়া, বাহেরচরসহ সংলগ্ন সব মৌজার জমিই এখন তার। নিজের দেয়া হিসাব অনুযায়ী ক্রয়কৃত জমির বিস্তার ২ হাজার ৮৬৫ একর। তবে সার্ভেয়ার শিকল ধরলে পরিমাণ ছাড়ি
য়ে যাবে সাড়ে ৩ হাজার একর। ওই এলাকায় যতদূর চোখ যায় শুধু সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের জমি। এ জমি তিনি কিনেছেন পাঁচ বছর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে। স্ত্রী প্রীতি রহমান ওরফে প্রীতি হায়দারের নামেও কিনেছেন কয়েকশ’ একর জমি। পাঁচ বছর আগেও মাত্র ২০ একর জমির মালিক ছিলেন তারা। আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতোই কয়েক বছরে এ জনপ্রতিনিধি মালিক হন হাজার হাজার একর জমির। যার অনুসন্ধান দুদককে শুধু বিস্মিতই করেছে। কবে, কার কাছ থেকে কত টাকায় কিনেছেন এসব জমি- দুর্নীতি দমন কমিশন এখন মিলিয়ে দেখছে সেসব। মাহবুবুর রহমানের কেনা সাড়ে ৩শ’ একর জমির অন্তত ১৬৭টি সাবকবলা দলিল এখন দুদকের হাতে। আমমোক্তারনামার মাধ্যমে মালিক হওয়া জমির ১৯টি দলিলও রয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি জমিগুলো কেনেন। কত টাকার জমি কিনেছেন তার মোট হিসাব দুদক এখনও করেনি। তবে দলিলে উল্লেখিত জমির মূল্য ও প্রকৃত মূল্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছে দুদক। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত মহাজোট সরকারের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে গত ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া অনুসন্ধান এখন শেষ পর্যায়ে। নবম জাতীয় সংসদে দাখিলকৃত হলফনামা, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাখিলকৃত হলফনামা, সম্পদ বিবরণী, মাহবুবুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ, তার এপিএস শামীম আল সাইফুল সোহাগকে জিজ্ঞাসাবাদ, সরেজমিন পরিদর্শন, স্থানীয় জেলা রেজিস্ট্রার দফতর, সাবরেজিস্ট্রি, ভূমি অফিস, ডাক বিভাগ, জয়েন্ট স্টক কোম্পানি, স্টক এক্সচেঞ্জ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানিসহ ২৪টি উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রণীত হচ্ছে অনুসন্ধান প্রতিবেদন। সূত্র মতে, মাহবুবুর রহমান দম্পতির দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীর সঙ্গে বিদ্যমান প্রকৃত অর্থ-সম্পদের রয়েছে বিস্তর ফারাক। জমি কেনায় যে অর্থ তিনি লগ্নি করেছেন তার নেই দৃশ্যমান বৈধ কোনো উৎসও। তবে অনুসন্ধান কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানের নির্বাচনী এলাকা পরিদর্শন করে কিছু প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পেয়েছেন যা তিনি দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেননি। ‘আন্ধারমানিক’ ও ‘গঙ্গামতি’ নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে মাহবুবুর রহমান ও প্রীতি হায়দারের নামে। প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে তিনি এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে বেআইনিভাবে ‘ব্যবসা’ করেন। কথিত দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেনামে মাহবুবুর রহমান দম্পতি বাগিয়ে নেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের যত ঠিকাদারি। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প তৈরি, অর্থ বরাদ্দ, ড্রেজিং না করেই বরাদ্দকৃত অর্থ উত্তোলন, কার্যাদেশ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেয়া, নদীর নাব্যতা আনয়নের নামে কোনো কাজ না করেই বিল উত্তোলনের প্রমাণ পাওয়া গেছে সাবেক এ প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। তবে তিনি হলফনামায় নিজের আয়ের ৭টি উৎস দেখালেও বাস্তবে এসবের অস্তিত্ব মেলেনি। মৌসুমি ফসল মজুদ করে পরে তা বিক্রির ব্যবসা করেন বলে দাবি করলেও দক্ষিণাঞ্চলের হিমাগার বা গুদাম ঘরগুলোতে তার এমন কোনো ব্যবসার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। দুদক সূত্র জানায়, পাঁচ বছরে লুণ্ঠিত অর্থের বিশাল একটি অংক তিনি অস্ট্রেলিয়া পাচার করেছেন- মর্মেও তথ্য মিলেছে। স্ত্রী প্রীতি হায়দার, দুই মেয়ে, মেয়ের জামাই, নাতি-নাতনি নিয়ে এখন অস্ট্রেলিয়া বসবাস করছেন। সেখানে বসবাসের ব্যবস্থা তিনি আগেই করে রেখেছেন। নিজ এলাকায় হাজার হাজার একর জমি কিনলেও রাজধানীতে তেমন কিছু কেনেননি মাহবুব। ঢাকার উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে ৭ কাঠার একটি মাত্র প্লট রয়েছে। যাতে ৬ তলা ভবন নির্মাণাধীন। বিপুল পরিমাণ সম্পদ কিভাবে অর্জন করেছেন জানতে চাইলে সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, দুদক অনুসন্ধান করছে। কোনো মন্তব্য নয়। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ৫ বছরে তিনি ২০ একর জমি থেকে ২ হাজার ৮৬৫ একর জমির মালিক হয়েছেন। নবম সংসদের হলফনামা অনুসারে ৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ছাড়া কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ না থাকা স্ত্রীর নামে এখন ১ কোটি ২৬ লাখ ৭১ হাজার টাকার সম্পদ। নিজের ৩৬ লাখ ৩৩ হাজার ১১২ টাকার স্থাবর সম্পদ কয়েক বছরের ব্যবধানে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ২৫ লাখ ৬৬ হাজার ৭২ টাকা। ২০০৮ সালের হলফনামায় ৭টি আয়ের উৎস খাতের মধ্যে তার একমাত্র আয় ছিল খণ্ডকালীন ‘রাখি’ মালামাল থেকে, যার পরিমাণ ছিল বছরে ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তিনি এখন মৎস্য উৎপাদন ও বিক্রয়কারী। আর এ খাত থেকে তার বছরে আয় প্রদর্শন করেন ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আগে তার ওপর নির্ভরশীলদেও কোনো আয়ের উৎস না থাকলেও এখন তার ওপর নির্ভরশীলদের ব্যবসা থেকে বছরে আয় ৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এছাড়া চাকরি থেকে তার বছরে আয় ২০ লাখ ৩৪ হাজার ৭০০ টাকা। মাহবুবুর রহমানের সম্পদের অবিশ্বাস্য স্ফীতি দেখে টনক নড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের। ১২ জানুয়ারি নিয়মিত বৈঠকে মাহবুবুর রহমানের সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয় উপপরিচালক খায়রুল হুদাকে। অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় ২৩ ফেব্র“য়ারি মাহবুবুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নোটিশ জারির পরিপ্রেক্ষিতে মার্চে তিনি প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারির আগেই তার স্ত্রী প্রীতি হায়দার অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান। সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের অনুসন্ধান-অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মোঃ বদিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, মাহবুবুর রহমানসহ ক্ষমতাসীন দলের সাবেক মন্ত্রীর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান এখন শেষের দিকে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন কমিশনে জমা পড়বে বলে আশা করছি।  

No comments:

Post a Comment