বাংলাদেশ-ভারত পানিচুক্তির ১৮ বছর পার হলেও চুক্তি অনুযায়ী বেশির ভাগ সময় পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি বাংলাদেশ। দুই দেশের মধ্যে পানির প্রবাহ পরিমাপকারী দলের বাংলাদেশী প্রকৌশলীরা চুক্তি অনুযায়ী পদ্মায় পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি করে এলেও তা আমলে নেয়নি ভারত। ফলে পদ্মার বুকে জেগে উঠছে মাইলের পর মাইল বালুচর। এতে কৃষি সেচসহ পরিবেশের ওপর পড়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। এ অবস্থায়ই গত ১২ ডিসেম্বর পানি চুক্তির ১৮ বছর প
ূর্ণ হলো। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের হায়দারাবাদ হাউজে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে দুই দেশের মধ্যে ভারতের অংশে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি কার্যকর শুরু হয়। বাংলাদেশের পক্ষে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের পক্ষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার মধ্যে এই চুক্তি হয়। কিন্তু চুক্তির পর ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও পদ্মায় প্রয়োজনীয় পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের নদীনালা শুকিয়ে খালে পরিণত হয়ে কৃষি ও পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এই চুক্তি নিয়ে দেশের পানি বিশেষজ্ঞদের রয়েছে নানা প্রশ্ন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য মিঠাপানির প্রধান উৎস এবং পদ্মার প্রধান শাখা গড়াই নদী শুষ্ক মওসুমে শুকিয়ে যায়। পদ্মা শুকিয়ে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা গুলোতেও বিরূপ প্রভাব পড়ে। পদ্মার সাথে সংযোগকারী অন্যান্য নদীও শুকিয়ে যাওয়ায় পদ্মার দুই পাশের জেলাতে সেচনির্ভর ফসল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরিবেশসহ জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়ে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিবেদক গত ১৮ ডিসেম্বর পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে গিয়ে নদীর বুকজুড়ে ধূধূ বালুচর দেখতে পান। রেল সেতু ও সড়ক সেতুর নিচে চাষাবাদ হচ্ছে। নদীর পানিপ্রবাহ একেবারেই স্থির। অন্য দিকে পাবনা শহর থেকে দক্ষিণে ছয় কিলোমিটার দূরে পদ্মার বাম তীর। এখান থেকে পদ্মার ওপারে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। নদী এখানে শুকিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। নদীর বুক চিরে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার শুধু বালুচর। এ বালুচরের মধ্যে দু’টি স্থানে পানির সরু চ্যানেলে নৌকা রয়েছে। নৌকায় পার হয়ে বালুচরে আবার হাঁটতে হয় চার কিলোমিটার। এক সময়ের প্রমত্তা নদীর বালুচরেই এখন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ নদী পারাপার হচ্ছে। যা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। নদীর ডান তীর অর্থাৎ কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কোল ঘেঁষে যে শীর্ণ সরু ক্যানেলের মধ্যে পানি আছে তা সাঁতরে পার হতে পারে মানুষ। এ সরু ক্যানেল পার হওয়ার জন্য এখানে আছে একটি নৌকা। এ নৌকায় পার হতে সময় লাগে পাঁচ মিনিট। পাবনা শহর থেকে দক্ষিণে পদ্মার উত্তর পাড় পর্যন্ত দূরত্ব ছয় কিলোমিটার। এরপর প্রায় চার কিলোমিটার বালুচর। এ বালুচর পাড়ি দিতে মানুষ এখন ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করছে। জনপ্রতি ভাড়া ৩০ টাকা। সময় লাগে ৪৫ মিনিট থেকে প্রায় এক ঘণ্টা। শীর্ণদশা নদীর খেয়াঘাটের মাঝি সোহেল আলী জানান, প্রতিদিন ও পারের কুষ্টিয়া জেলার আর এ পারের পাবনার তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মানুষ নদীর চর দিয়ে পারাপার হয়ে থাকে। ভোর বেলা ও বিকেলে হেঁটে পার হওয়া গেলেও ভরদুপুরে এ বালুচর দিয়ে পায়ে চলা দুষ্কর। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উজান থেকে শুরু করে পদ্মা-যমুনার মোহনায় যেখানে পাবনার বেড়া ও রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের কাছে পদ্মা মিলিত হয়েছে সেখান পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার এলাকায় পদ্মার বুকে বালুচর। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি বিভাগের একজন প্রকৌশলী দাবি করেন, বাংলাদেশ-ভারত ৩০ বছরের চুক্তিমাফিক পানি পাওয়া যাচ্ছে, তবে এ পানি পদ্মার বুক প্রবহমান করার মতো নয়। তাই শুষ্ক মওসুমে পদ্মার বুকে ধূধূ বালুচর। তিনি আরো বলেন, ১৯৯৬ সালে দুই দেশের মধ্যে পানিচুক্তির পর থেকে পদ্মার এ করুণ দশা হচ্ছে। চুক্তির মধ্যেই শুভঙ্করের ফাঁকি আছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, পানিচুক্তি অনুযায়ী প্রতি শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে সর্বনি¤œ ৩৫ হাজার পানি পাওয়ার যে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে তা এ নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য পর্যাপ্ত নয়। এ কারণে প্রতি বছর শুষ্ক মওসুমে পদ্মায় পানি থাকে না, একই সাথে প্রধান শাখা গড়াইসহ অন্যান্য শাখা নদী শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়। এ ছাড়া পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ঢালুতে দেশের অন্যতম প্রধান সেচপ্রকল্প জিকে প্রকল্প শুষ্ক মওসুমে পানির অভাবে শুকিয়ে যায়। এ প্রকল্পের পানির একমাত্র উৎস হচ্ছে পদ্মার পানি।
No comments:
Post a Comment