Wednesday, December 17, 2014

ভালুকায় স্ত্রী, দুই সন্তানসহ শ্রমিক দল নেতাকে হত্যা:কালের কন্ঠ

ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় একজন পরিবহন মালিক, তাঁর স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গত সোমবার রাতে উপজেলার হবিরবাড়ী ইউনিয়নের লবণকোঠা গ্রামে
এ নির্মম হত্যাকাণ্ডটি ঘটে। নিহত চারজন হলেন পরিবহন মালিক ও স্থানীয় শ্রমিক দলের নেতা রফিকুল ইসলাম বাচ্চু (৩৫), তাঁর স্ত্রী পারুল আক্তার (২৫), মেয়ে জিনিয়া (৭) ও হোসনা (দেড় বছর)। গতকাল সকালে পুলিশ চারজনের লাশ উদ্ধার করে থানা হেফাজতে নেয়। আজ বুধবার সকালে ময়নাতদন্তের জন্য ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে লাশগুলো পাঠানো হবে। তাঁদের মধ্যে বাচ্চুর লাশ উদ্ধার করা হয় বাড়ির সামনে রাখা নিজের বাসের ভেতর থেকে। স্ত্রী ও দুই মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে বসতঘরের ভেতর খাটের পাশে। বাচ্চু ও পারুলকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। দুই মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে শ্বাস রোধ করে। রফিকুল ইসলাম বাচ্চু উপজেলার পাড়াগাঁও বড়চালা গ্রামের ওয়ারেস আলীর ছেলে। তিনি হবিরবাড়ী ইউনিয়ন শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্ত্রী-সন্তানসহ হত্যার শিকার রফিকুল তিনি নিজের মালিকানাধীন বাসে উপজেলার রানার গ্রুপের শ্রমিক পরিবহনের কাজ করতেন। মেয়ে জিনিয়া পড়ত বাড়ির পাশের নক্ষত্র ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকার শত শত নারী-পুরুষ বাচ্চুর বাড়িতে ভিড় জমায়। একপর্যায়ে আলামত রক্ষায় হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে। পুলিশের পাশাপাশি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে র‌্যাব, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তবে গতকাল সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এক পরিবারের এ চারজনকে হত্যার রহস্য জানাতে পারেনি নিহতের পরিবার ও পুলিশ। তবে পরিবারের লোকজন তনু নামে বাচ্চুর এক বন্ধুকে সন্দেহ করছে। এ ছাড়া স্থানীয় বিএনপির রাজনৈতিক কোন্দলের কারণেও বাচ্চুকে স্ত্রী-সন্তানসহ হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে তারা সন্দেহ করছে। ভালুকা থানার ওসি গোলাম সারওয়ার জানান, তনুর খোঁজে তাঁর সিডস্টোরের ভাড়া বাসায় পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় বাচ্চুর বাবা বাদী হয়ে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত মামলা হয়নি। পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম স্ত্রী ও পাঁচ বছরের একটি ছেলেসন্তান থাকা অবস্থায় প্রায় ১০ বছর আগে রফিকুল ইসলাম বাচ্চুর সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়া করে বিয়ে হয় ঢাকার উত্তরখান নগদাপাড়া গ্রামের তারাজ উদ্দিনের মেয়ে পারুল আক্তারের। পরে উপজেলার লবণকোঠা গ্রামে জমি কিনে বাড়ি করেন পরিবহন ব্যবসায়ী বাচ্চু। বছর পাঁচেক হলো তিনি ওই বাড়িতেই সপরিবারে বসবাস করে পরিবহন ব্যবসা করছিলেন। আবদুল্লাহপুর-ঢাকা রুটের বাসে চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করেন বাচ্চুর সম্বন্ধি উকিল উদ্দিন ভুঁইয়া। বাচ্চুর বাড়ির পাশে তিনিও এক খণ্ড জমি কিনে আলাদা বাড়ি করেন। ওই বাড়িতে বাচ্চুর শাশুড়ি আলতন বেগম থাকেন। কাজের ফাঁকে মাঝে-মধ্যে বাড়িতে মায়ের কাছে আসেন উকিল উদ্দিন। ঘটনার রাতে তিনি ওই বাড়িতেই ছিলেন। উকিল উদ্দিন বলেন, 'সোমবার রাতে বাড়িতেই আছিলাম। মা কইছে পিঠা বানাইয়া তাঁর নাদিগ খাওয়াইব। হের লিগা সোমবার রাইতে সাত শ টেকার বাজর করছি। গতকাল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ঘুম থাইকা উইঠা বোনের ঘরের দিকে তাকায় দেহি ঘরের দরজা তালাবদ্ধ। পরে ঘরের জানালা দিয়া উঁকি দেয়া কাউরেই ঘরে দেখবার পাইলাম না। পরে মনে অইল বইন বোধ অয় তার বাচ্চারে লাইয়া ইস্কুলে গেছে। কিন্তু হেইহানেও তারে পাইলাম না। পরে জামাইর মোইলে রিং দেয়াও কুনু সাড়া-শব্দ পাই না। পরে দৌড়াইয়া গিয়া বেয়াইরে (রফিকুলের ভাই) জানাইলাম। হের পরে ঘরে গিয়া দেহি খাটের চিপাত বইন আর দুই ভাগনির লাশ পাইড়া রইছে। পরে গাড়িত গেয়া দেহি জামাইর লাশ।' উকিল উদ্দিন জানান, বাচ্চুর বন্ধু তনু সোমবার দুপুরে তাঁর বাড়ি থেকে একটি দা নিয়ে গেছে। ঘটনার পর থেকে তনুকে আর দেখা যায়নি। তিনি আরো জানান, তনুর বাড়ি যশোরে। সিডস্টোর এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে একসময় কোনো একটা মিলে কাজ করতেন তিনি। বন্ধুত্বের সুবাদে বাচ্চুর বাড়িতে যাতায়াত ছিল তাঁর। কিন্তু খারাপ প্রকৃতির লোক হওয়ায় তাঁর মা ও বোন তনুকে পছন্দ করতেন না। কী একটা কারণে মাস তিনেক আগে তনুর সঙ্গে বাচ্চুর ঝগড়া হয়। পরে আবার দুজনের মাঝে মিল হয়। উকিল উদ্দিন জানান, তাঁর বোন পারুল আক্তারের এটি দ্বিতীয় বিয়ে। বাচ্চুর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার অনেক আগে ফরিদপুরের দেলোয়ারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। বাচ্চুর শাশুড়ি আলাতন বেগম জানান, সোমবার রাত ৯টা-১০টার দিকে গাড়িসহ (বাস) বন্ধু তনুকে (২৫) সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে আসেন তাঁর মেয়ের জামাই। এসে পারুলকে বলেন তনুকে খাবার দেওয়ার জন্য। কিন্তু তনুকে খাবার দিতে চাননি পারুল। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, তনু খারাপ প্রকৃতির মানুষ। কাজেই পারুল ও তিনি তনুকে সহ্য করতে পারতেন না। আলাতন বেগম আরো জানান, রাতে খাবার খাওয়ার পর বাড়ির সামনে রাখা গাড়ির দিকে যাওয়ার সময় তিনি মেয়ের জামাই বাচ্চুকে ডেকে তনুর সঙ্গে যেতে বারণ করেন। তখন বাচ্চু তাঁকে কোনো সমস্যা নেই জানিয়ে শুয়ে পড়তে বলেন। খবর পেয়ে ছেলের বাড়িতে এসে আহাজারি করছিলেন বাচ্চুর মা রাবেয়া খাতুন। বিলাপ করে তিনি বারবার বলছিলেন, 'তুমরা আমার বাবারে আইন্যা দেও। আল্লা, আল্লাগো আমার কী সর্বনাশ অইল গো। আমার বাবারে কেডা মারছে, আমনেরা হেরে ধরুইন। আমি আর কিছ্ছু চাই না। আমার বাবারে চাই।' বাচ্চুর বাবা ওয়ারেস আলী জানান, গতকাল সকাল ৮টার দিকে মোবাইল ফোনে খবর পেয়ে তিনি ওই বাড়িতে ছুটে এসেছেন। তখন এর বেশি আর কিছু বলতে পারেননি তিনি। বাচ্চুর ভাই নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, তাঁর ভাই উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফখর উদ্দিন আহাম্মেদ বাচ্চু গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন হবিরবাড়ী ইউনিয়ন শ্রমিকদলের সাধারণ সম্পাদক। রাজনীতির কারণে স্থানীয় শ্রমিকদলের একটি পক্ষের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। মাস তিনেক আগে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা বাচ্চুকে মেরে সিডস্টোর বাজারে ফেলে রেখেছিল। পরে ওই ঘটনায় তাঁর ভাই বাদী হয়ে ভালুকা মডেল থানায় একটি মামলাও করেছিলেন। স্ত্রী-সন্তানসহ বাচ্চুকে খুনের পেছনে রাজনৈতিক কোন্দল বা তনুর হাত থাকতে পারে বলে তিনি সন্দেহ করছেন। খবর পেয়ে উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফখর উদ্দিন আহাম্মেদ বাচ্চু ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসেমসহ দলের নেতারা বাচ্চুর বাড়িতে যান। ফখর উদ্দিন আহাম্মেদ বাচ্চু কালের কণ্ঠকে জানান, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং দলীয় মিটিং-মিছিলের অগ্রভাগের নেতা ছিলেন রফিকুল ইসলাম বাচ্চু। তিনি নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে ওই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা র‌্যাব-১৪-এর কম্পানি কমান্ডার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মনজুর রহমান জানান, ঘটনাটি খুবই চাঞ্চল্যকর এবং বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দেখা হচ্ছে। ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু আহাম্মেদ আল মামুন জানান, হত্যাকাণ্ডের রহস্য এখনো জানা যায়নি। তদন্ত চলছে, বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানায়, লবণকোঠা গ্রামটি খুবই শান্ত। রাতের যেকোনো সময় তারা নির্ভয়ে, অবাধে ও নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতে পারত। কিন্তু ওই হত্যাকাণ্ডের পর আতঙ্কিত ও ভীত হয়ে পড়েছে গ্রামের মানুষ। তারা ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায়। প্রতিবেশী দোকানি ফাতেমা খাতুন জানান, বাচ্চুর বাড়িতে বাইরের লোকের যাতায়াত ছিল খুবই কম। প্রতিবেশী হলেও ওই বাড়িতে তাঁদের যাতায়াত ছিলই না বলা চলে।    

No comments:

Post a Comment