Thursday, December 4, 2014

দুই রোগীর দেহ থেকে কিডনি চুরি!:যুগান্তর

রাজধানীর দুটি বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অপারেশনের নামে কিডনি চুরির ভয়াবহ অভিযোগ উঠেছে। যাত্রাবাড়ীর মেডিকম জেনারেল হাসপাতালে পায়ের ব্যথা নিয়ে ভর্তি হওয়া এক নারী রোগীর কিডনি কেটে নেয়ার অভিযোগ করেছেন তার স্বজনরা। আর উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ- লেজার পদ্ধতিতে পাথর অপসারণের সময় এক রোগীর কিডনি কেটে নেয়া হয়। পৃথক দুই ঘটনায় কিডনি হারিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন যাত্রাবাড়ীর মীর হাজ
িরবাগের ৬৫ বছর বয়সী ফুলমালা বেগম ও ৪৫ বছর বয়সী গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বাবুল সরকার। ফুলমালা বেগমের ঘটনা ধামাচাপা দিতে ৬০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে আপস-রফার চেষ্টা করেছে মেডিকম জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আর বাবুল সরকারের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ দুই ঘটনায় হাসপাতাল দুটির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। বাবুল সরকারের শ্যালক মোমেন সরকার যুগান্তরকে জানিয়েছেন, গত মাসের শেষদিকে হঠাৎ করে কোমরের পেছনে ব্যথা অনুভব করেন তার ভগ্নিপতি বাবুল সরকার। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে উত্তরার আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। ওই হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. সাব্বির আহমেদের তত্ত্বাবধানে তার ভগ্নিপতিকে ভর্তি করা হয়। তিনি বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা তাদের জানান, ‘কিডনিতে পাথর হয়েছে। লেজার পদ্ধতিতে ওই পাথর অপসারণ করতে হবে।’ মোমেন সরকার আরও বলেন, অধ্যাপক সাব্বির চিকিৎসা বাবদ ২০ হাজার খরচ হবে বলে তাদের জানান। চিকিৎসকের চাহিদা অনুযায়ী তারা হাসপাতালে ২০ হাজার টাকা জমাও দেন। এরপর ২৬ নভেম্বর সকালে বাবুল সরকারকে কিডনি থেকে পাথর অপসারণের জন্য হাসপাতালের অস্ত্রোপচারকক্ষে নেয়া হয়। প্রায় দু’ঘণ্টা পর একজন চিকিৎসক এসে তার বোনকে (বাবুল সরকারের স্ত্রী) জানান, ‘পাথরগুলো কিডনির সঙ্গে লেপ্টে থাকায় ডান কিডনিটি কেটে ফেলতে হতে পারে। তখন তার বোন চিকিৎসককে বলেন, তিনি তার ভাইদের সঙ্গে কথা বলে জানাবেন। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত দেয়ার আগেই চিকিৎসকরা বাবুল সরকারের একটি কিডনি কেটে ফেলেন বলে যুগান্তরের কাছে অভিযোগ করেন মোমেন সরকার। বাবুল সরকারের স্ত্রী সুরাইয়া বেগম বুধবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, কিডনি কেটে ফেলতে হতে পারে এমন কথা চিকিৎসকরা অপারেশনের আগে কখনও বলেননি। এছাড়া লেজার পদ্ধতিতে পাথর অপসারণের সময় কিডনি কাটার প্রয়োজনীয়তা কেন পড়ল তা তারা বুঝতে পারছেন না। বর্তমানে মুমূর্ষু অবস্থায় বাবুল সরকার ওই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুরাইয়া বেগম বলেন, কিডনি হারানোর কথা এখনও তার স্বামীকে জানানো হয়নি। বাবুল সরকারের ঘটনায় অভিযোগ ওঠার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। হাসপাতালেরই তিন অধ্যাপককে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছে। তবে প্রথমে কমিটিতে কোনো সময় বেঁধে দেয়া না হলেও মঙ্গলবার বিষয়টি জানাজানি হলে নতুন করে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ওই হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘অপারেশন করার আগেই কিডনি কেটে ফেলতে হতে পারে এমন কথা বাবুল সরকারের স্ত্রীকে জানানো হয়েছিল।’ এখন তারা কেন এ ধরনের অভিযোগ করছেন তা তারা বুঝতে পারছেন না। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে হাসপাতালটির পরিচালক মো. শাহজাহান বিশ্বাস যুগান্তরকে বলেন, ৩০ নভেম্বর এ ধরনের একটি লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর ১ ডিসেম্বর কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তের পরই প্রকৃত ঘটনা বলা যাবে। তবে সহকর্মীদের দিয়ে চিকিৎসক সাব্বির আহমেদের বিষয়ে তদন্ত হলে তা সুষ্ঠু হবে না বলে মনে করছেন বাবুল সরকারের স্বজনরা। তারা অন্য হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে ঘটনার তদন্তও দাবি করেছেন। এদিকে এ ঘটনায় ৩০ নভেম্বর উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন বাবুল সরকারের শ্যালক মোমেন সরকার। তবে এখনও অভিযোগটি সাধারণ ডায়েরি কিংবা মামলা হিসেবে রেকর্ড হয়নি। উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, এ ধরনের অভিযোগ গ্রহণের আগে সিভিল সার্জনের অনুমতির প্রয়োজন হয়। অভিযোগ দায়েরের সময় অভিযোগকারীকে মামলার জন্য ঢাকার সিভিল সার্জনের অনুমতি নেয়ার বিষয়টি জানানো হলেও বুধবার পর্যন্ত তা পাওয়া যায়নি বলে তিনি জানান। অনুমতি পেলে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। যাত্রাবাড়ীর মেডিকম জেনারেল হাসপাতাল পায়ের ব্যথা নিয়ে গত মাসের প্রথম সপ্তাহে যাত্রাবাড়ীর মেডিকম জেনারেল হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেডে ভর্তি হন ৬৫ বছর বয়সী ফুলমালা বেগম। ফুলমালা বেগমের ছোট ছেলে আহমেদ আলী জানান, হাসপাতালে ভর্তির পর অপারেশন করার কথা বলেন চিকিৎসকরা। ১৬ নভেম্বর টানা ৫ ঘণ্টা অপারেশনের পর দেখা যায় পায়ের পাশাপাশি অপারেশন করা হয়েছে পেটের নিচের অংশেও। আহমেদ আলী বলেন, গত রমজান মাসে বাথরুমে পড়ে পায়ের গোড়ালিতে আঘাত পান তার মা। ওই সময়ে চিকিৎসার জন্য তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নেয়া হয়। ওই হাসপাতাল থেকে অপারেশন করার কথা বলা হয়। কিন্তু এ বয়সে অপারেশনের ঝামেলায় না গিয়ে এতদিন তারা মাকে কবিরাজি চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু ভালো না হওয়ায় তাকে নেয়া হয় যাত্রাবাড়ীর মেডিকম হাসপাতালে। সেখানে অপারেশনের কথা জানান চিকিৎসকরা। তিনি আরও জানান, ১৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত অপারেশন চলে। ডা. মধুসূদন পাল, ডা. আবদুল করিমসহ ৪ জন চিকিৎসক তার মায়ের অপারেশন করেন। অপারেশন শেষে তার বড় ভাই মোহাম্মদ আলী অপারেশন থিয়েটারের গিয়ে পায়ের পাশাপাশি মায়ের পেটের অপারেশনের বিষয়টি জানতে পারেন। এ সময় প্রশ্ন করা হলে চিকিৎসকরা জানান, পেট থেকে হাড়ের টুকরো নিয়ে পায়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আহমেদ আলী বলেন, অপারেশন শেষে অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় তার মাকে গ্রিন রোডের গ্রিন কিডনি অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ৪ দিন পর মাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। শরীরের বিভিন্ন স্থান ফুলে যাওয়ায় তার মা বর্তমানে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন আছেন। আহমেদ আলী বলেন, নিজেদের ভুল চিকিৎসার কথা স্বীকার করে ওই সময় থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ মেডিকম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার খরচ বাবদ এ পর্যন্ত ৬০ হাজার টাকা দিয়েছে। এ ব্যাপারে যাত্রাবাড়ী থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে বলে জানান আহমেদ আলী। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি অবনি শংকর জানান, তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছেন। চিকিৎসকদের মতামত পেলেই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। মেডিকম হাসপাতালের ব্যবস্থাপক নেজামুল হক যুগান্তরকে বলেন, একটা আলট্রাসনোগ্রাম করলেই তো কিডনি কেটে নেয়া হয়েছে কিনা এ প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে। কোনো সমস্যা না থাকলে রোগীর স্বজনদের টাকা দিয়েছেন কেন এমন প্রশ্নের জবাবে নেজামুল হক বলেন, মানবিক বিবেচনায় তাদের টাকা দেয়া হয়েছে। এটাকে অন্যভাবে দেখা ঠিক হবে না।  

No comments:

Post a Comment