বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের মঞ্চে হঠাৎ করে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর অসুস্থ হয়ে যাওয়া এবং এর পরে তাঁর মৃত্যু—সব সুরে দিয়ে গেল বেদনার আঁচড়। শিল্পীরা গায়ন ও বাদনে স্মরণীয় করে রাখলেন কাইয়ুম চৌধুরীকে। সবাই তাঁদের পরিবেশনা উৎসর্গ করলেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা চিত্রশিল্পীকে। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর রাত ১০টা ২৪ মিনিটে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মঞ্চে উঠে ঘোষণা দিলেন, ‘কাইয়ুম চৌধুরী আর আমাদের মা
ঝে নেই। জীবন কখনো থেমে থাকে না। আমরা অনুষ্ঠান চালিয়ে যাব। কারণ, কাইয়ুম চাইতেন না যে এই অনুষ্ঠান থেমে যাক।’ তখন মঞ্চে সরোদ বাজাচ্ছিলেন ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের দুই ছেলে আমান আলী বাঙ্গাস ও আয়ান আলী বাঙ্গাস। বাজাচ্ছিলেন রাগ ঝিঁঝিট। তাঁরা তাদের পরিবেশনা উৎসর্গ করলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে। এই দুই শিল্পীর সঙ্গে তবলায় সংগত করেন সত্যজিৎ তালওয়ালকর। উত্তর ভারতের সঙ্গে দক্ষিণের জুটি বেঁধে সংগীত করাটা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে নতুন কিছু নয়। ওস্তাদ আলী আকবর খান, ভীমসেন যোশী, গিরিজা দেবী, আমজাদ আলী খানসহ আরও অনেকই দক্ষিণের লালগুড়ি জয়রামন, টি এন কৃষ্ণান, বালমুরালি কৃষ্ণান, এল শুভ্রামানিয়ামদের সঙ্গে যুগলবন্দী করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মঞ্চে এমনটা কখনো দেখা যায়নি। সেই অপেক্ষার পালা শেষ হলো। গতকাল রোববার বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের চতুর্থ রাতে কাইয়ুম চৌধুরীকে উৎসর্গ করে পশ্চিম বাংলার সরোদিয়া পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার দক্ষিণ ভারতের বেহালাশিল্পী গণেশ রাজা গোপালনের সঙ্গে জুটি বেঁধে বাজালেন রাগ হিন্দোলম। এই দুই শিল্পীকে তবলায় সহযোগিতা করেন যোগেশ শামসী এবং মৃদঙ্গে রবিশংকর ভদ্রাচর। কণ্ঠশিল্পী সামাহিন কাশালকর খেয়াল শুরুর আগে বললেন, ‘আজ এখানে কিছুক্ষণ আগে যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, তাতে কী গাব, কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে আমি আমার আজকের পরিবেশনা কাইয়ুম সাহেবকে (শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী) উৎসর্গ করলাম।’ চারটি রাত যেন পেরিয়ে গেল চোখের পলকে। আনন্দের সময় নাকি দ্রুতই পেরিয়ে যায়। রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে রোজ সন্ধ্যা থেকে ভোর অবধি হাজার হাজার বিমুগ্ধ শ্রোতার রাতজাগা সময়টি আনন্দে ভরিয়ে তুলেছেন উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত গাইয়ে-বাজিয়েরা। দ্বিধাহীন কণ্ঠে তাঁরা বলেছেন, মাত্র তিন বছরেই এই উৎসব পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উচ্চাঙ্গসংগীতের উৎসবে। গতকালও স্টেডিয়াম ছিল পরিপূর্ণ। সবাই আগেই জেনেছিলেন বাঁশির সুরের জাদুতে রাতের স্তব্ধতাকে বাঙ্ময় করে তুলবেন ভুবনখ্যাত পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। আগের উৎসবগুলোতেও যেমন দেখা গেছে, ঠিক এবারও তেমনি চৌরাসিয়ার বাঁশি শুনতে ঘটেছিল হাজার হাজার আবালবৃদ্ধবনিতার সমাগম। সুরের ইন্দ্রজালে ভেসেছেন তাঁরা। চৌধুরীর ভরতনাট্যম দিয়ে শুরু হয়েছিল রোববার চতুর্থ দিনের অধিবেশন। রাতের আসরের শিল্পীদের মধ্যে আরও ছিলেন কৌশিকী চক্রবর্তী। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীতের পাঁচ দিনের মহোৎসবে সার্বিক সহায়তা দিচ্ছে প্রথম আলো। স্কয়ার নিবেদিত বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের এ আয়োজনে আরও সহায়তা দিচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংক, ডেইলি স্টার, এবিসি রেডিও ও মাছরাঙা টেলিভিশন। নৃত্যের পর তবলা লহরা পরিবেশন করেন ঢাকার তরুণ বাজিয়ে স্বরূপ হোসেন। তবলাবাদনের পর ছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। গতকাল প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বিশেষ অতিথি ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও স্কয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবুল খায়ের। আগের রাতের বিশেষ: শনিবার মধ্যরাতের পর মঞ্চে এসেছিলেন কর্ণাটকি শিল্পী বিদুষী অরুণা সাইরাম। তিনি ২০১২ সালে প্রথম উৎসবেও গেয়ে শ্রোতাদের মন ভরিয়েছিলেন। এবারও মাতালেন বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা দিয়ে। শেষ দিনের পরিবেশনা: আজ শেষ দিনের পরিবেশনা শুরু হবে সম্মেলক কণ্ঠে স্থানীয় শিল্পীদের গাওয়া বাংলা গান দিয়ে। এরপর থাকবে বিশাল কৃষ্ণের নৃত্য। বাঁশি বাজাবেন মনিরুজ্জামান। কণ্ঠসংগীত পরিবেশন করবেন কিশোরী আমানকার, অশ্বিণী ভিডে পাণ্ডে ও উদয় ভাওয়াল কর। আসর শেষ হবে আমজাদ আলী খানের সরোদবাদন দিয়ে।
No comments:
Post a Comment