Monday, December 15, 2014

নিঃসরণ কমাতে মতৈক্য, তবে বাধ্যবাধকতা নেই:প্রথম অালো

অবশেষে, প্রায় দেড় দিন বিলম্বের পর, জাতিসংঘের সদস্য বিশ্বের ১৯৪টি দেশ সর্বসম্মতভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধের লক্ষ্যে খসড়া চুক্তিটি গ্রহণ করেছে। আগামী বছর ডিসেম্বরে প্যারিসে পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলনে এ খসড়ার ভিত্তিতে নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা। ‘লিমা কল ফর ক্লাইমেট অ্যাকশন’ নামে ঘোষিত এ খসড়া চুক্তিতে শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল সব সদস্যরাষ্ট্র উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কম
াতে সম্মত হয়েছে। তবে কে কী পরিমাণ নিঃসরণ করতে পারবে, তা প্রতিটি দেশ তার নিজস্ব বাস্তবতার নিরিখে নির্ণয় করবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে প্রতিটি দেশ যার যার নিঃসরণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে জাতিসংঘের কাছে পৌঁছে দেবে। জাতিসংঘ পর্যায়ক্রমে তা প্রকাশ করবে। ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত কিয়োটো প্রটোকলে নিঃসরণ মাত্রা কমানোর দায়িত্ব পড়েছিল শুধু শিল্পোন্নত দেশের ওপর। ‘লিমা পরিকল্পনায়’ শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশই নিঃসরণ মাত্রা নির্ধারণে সম্মত হয়েছে। এতে কেউ কেউ এই পরিকল্পনাকে যুগান্তকারী হিসেবে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে, যাঁরা লিমা বৈঠকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে এমন আশা করেছিলেন, তাঁরা হতাশ হয়েছেন। গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ মাত্রা হ্রাসের মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার যে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা জাতিসংঘ নিয়েছিল, লিমা পরিকল্পনার ফলে তা বাস্তবায়িত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারসহ বিভিন্নভাবে উৎপাদিত কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ কিছু গ্যাস তাপমাত্রা আটকে রেখে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে মেরুর বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে এবং দ্বীপের মতো নিচু ভূখণ্ডগুলো ক্রমশ তলিয়ে যাবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বের জলবায়ুতেও চরমভাবাপন্নতা দেখা যাচ্ছে। চুক্তিভুক্ত দেশগুলো ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠেয় প্যারিস সম্মেলনের আগে যার যার নিঃসরণ মাত্রা নির্ধারণে সম্মত হলেও সে মাত্রা কীভাবে অর্জিত হবে, তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা তথ্য দেওয়ার ব্যবস্থা অনুমোদিত খসড়ায় রাখা হয়নি। পরিমাপযোগ্য তথ্য দেওয়া ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে। বিলি করা ইংরেজি খসড়াটিতে এর আগে প্রস্তাবিত ‘শ্যাল’ শব্দের স্থলে ‘মে’ শব্দ রাখা হয়েছে। প্রস্তাব রাখা হয়েছে, সদস্যরাষ্ট্রগুলো নিজ ইচ্ছায় নিঃসরণ মাত্রা রোধে যে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেবে, তা অর্জনের সময়সীমা ও সাফল্য নির্ধারণের পদ্ধতিসংক্রান্ত তথ্য জমা দিতে পারবে। তবে শর্ত হচ্ছে, কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বর্তমান সময়ের তুলনায় কম হতে হবে। জাতিসংঘ এ তথ্য নিরীক্ষার পর আগামী বছরের ১ নভেম্বরের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতার ওপর প্রস্তাবিত নিঃসরণ মাত্রার প্রভাব বিষয়ে একটি প্রতিবেদন পেশ করবে। রাষ্ট্রগুলোর নির্ধারিত নিঃসরণ মাত্রার তুলনামূলক সমীক্ষা প্রস্তুতের ব্যাপারে একটি প্রস্তাব চীন ও ভারতসহ বিভিন্ন অগ্রসর অর্থনীতির দেশের আপত্তির কারণে বাতিল করা হয়। স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে নিঃসরণ মাত্রা নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো দেশ তেমন পরিকল্পনা পেশ করলে তা স্বাগত জানানো হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলো বরাবর বলে এসেছে, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের দায়ভার মুখ্যত শিল্পোন্নত দেশগুলোর। উন্নয়নশীল দেশগুলো এখনো অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত মাত্রা অর্জন করেনি। কাজেই তাদের ঘাড়ে যদি এখনই নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব চাপানো হয়, তাহলে তা ন্যায়সম্মত হবে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোর এ দাবির মুখে লিমা পরিকল্পনায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে সব দেশের ‘সাধারণ কিন্তু পৃথক দায়দায়িত্ব’ রয়েছে বলা হয়। এ কথার অর্থ, বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে, তবে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হবে। এর আগে সম্মেলন সচিবালয় থেকে যে চতুর্থ খসড়া বিলি করা হয়, তাতে সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত দেশগুলোর বিষয়ে কোনো বক্তব্য না থাকায় তা প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। সম্মেলনের সভাপতি পেরুর পরিবেশমন্ত্রী মানুয়েল পুলগার-ভিদালের হস্তক্ষেপে খসড়ার ভাষা সংশোধন করে সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত দেশের জন্য অতিরিক্ত অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা মেনে নেওয়া হয়। কিন্তু অভিযোজনের জন্য সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকারের বিষয়ে তৃতীয় বিশ্বের দাবি যুক্তরাষ্ট্রসহ শিল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতিবাদের মুখে বাদ দেওয়া হয়। শিল্পোন্নত দেশগুলোর অভিযোজনের জন্য অর্থ দেওয়ার তথ্য ঐচ্ছিক ভিত্তিতে প্রদানের আহ্বান রাখা হয়েছে। অধিকাংশ সরকারি মুখপাত্র লিমা চুক্তিকে সাফল্য বলে চিহ্নিত করেছেন, যদিও বেসরকারি পর্যবেক্ষকেরা পুরো প্রক্রিয়ায় গভীরভাবে হতাশ। পেরুর পরিবেশমন্ত্রী মানুয়েল পুলগার-ভিদাল এ চুক্তিকে ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ আখ্যা দিয়ে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, এ চুক্তি আরও ভালো হতে পারত, কিন্তু এখন যে খসড়া গৃহীত হয়েছে, তাতে সব দেশের অবস্থানের প্রতিফলন রয়েছে। চীনের প্রতিনিধিদলের নেতা খি জেনহুয়া বলেন, ‘এ চুক্তিতে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই, তবে এটি আমাদের চোখে ভারসাম্যপূর্ণ ও সুন্দর।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দলনেতা টড স্টার্ন বলেন, আলোচনা বিবাদপূর্ণ হলেও শেষমেশ যে চুক্তি গৃহীত হলো তা বেশ ভালো। ভারতের পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভাদেকারও চুক্তিটিকে স্বাগত জানান। তাঁর কথায়, ‘আমরা যথার্থ ঐকমত্য অর্জন করতে পেরেছি।’ বেসরকারি পর্যবেক্ষকেরা অভিযোগ করেন, খসড়া চুক্তিটি সব পক্ষকে খুশি করার চেষ্টায় দুর্বল করে ফেলা হয়। এতে তারা ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এ জোটের সম্মিলিত মনোভাব প্রকাশ করে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের সামান্থা স্মিথ বলেন, ‘খসড়াটি এমনিতেই দুর্বল ছিল, তা ক্রমশ দুর্বলতর ও দুর্বলতম করে ফেলা হয়।’ নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলেছেন, লিমায় যে শেষ পর্যন্ত একটি চুক্তি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে, সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ চুক্তির ভিত্তিতে প্যারিসে আইনগত বাধ্যবাধকতাপূর্ণ একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে। এখন যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো যে আন্তর্জাতিক ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে, তা ধরে রাখা। এক পক্ষ মনে করে, নিজ নিজ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকৃত অগ্রগতি অর্জন সম্ভব। আশার কথা এই যে, বিভিন্ন দেশ চুক্তির বাইরে নিজ থেকেই ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ঘোষণা করেছে। নিঃসরণকারী দুই প্রধান দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ইতিমধ্যে তাদের পরিকল্পিত নিঃসরণ মাত্রা ঘোষণা করেছে। চীন বলেছে ২০৩০ সাল নাগাদ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে সে তার অভ্যন্তরীণ চাহিদার ২০ শতাংশ মেটাবে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ঘোষণা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালের মধ্যেই তাদের জ্বালানি চাহিদার ২০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আহরণ করবে। অন্যদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বলেছে, এ ধরনের উৎস থেকে তারা ২০৩০ সাল নাগাদ জ্বালানির ২৭ শতাংশ চাহিদা পূরণ করতে বদ্ধপরিকর। এ বিষয়ে সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ঘোষণা এসেছে ডেনমার্কের কাছ থেকে। তারা বলেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে পুরো জ্বালানি চাহিদাই মেটাবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। কোনো কোনো উন্নয়নশীল দেশও শূন্য কার্বন নিঃসরণ নীতি অনুসরণের কথা ঘোষণা করেছে। যেমন, কোস্টারিকা জানিয়েছে, ২০২১ সালের মধ্যে তারা পুরো জ্বালানি চাহিদা নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আহরণ করবে। লাতিন আমেরিকার আরেকটি দেশ উরুগুয়ে পুরো নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে যেতে চায় ২০১৫ সালের মধ্যে। লিমা সম্মেলন থেকে যে খসড়া চুক্তি পাওয়া গেছে, তা সবাইকে খুশি করবে না। কিন্তু এ সম্মেলন ঘিরে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ঠেকানোর ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের পক্ষে যে জনমত গড়ে উঠেছে, তাকে যদি ধরে রাখা যায়, তাহলে আগামীকালের পৃথিবী হয়তো বা বড় ধরনের আশু দুর্যোগ এড়াতে পারবে।

No comments:

Post a Comment