Thursday, December 18, 2014

বিএনপি নেতারাও বিব্রত সমর্থক সুধীসমাজ বিরক্ত:কালের কন্ঠ

অদূর ভবিষ্যতে সরকারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশে এত সব সমস্যা থাকতে তারেক রহমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কেন একের পর এক বিরূপ মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি করছেন- এ রহস্যের কূলকিনারা করত
ে পারছেন না খোদ বিএনপি নেতারাই। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা খুবই বিব্রত ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। তাই নানা হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে তাঁদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ভর করছে। বলা হচ্ছে, কেউ না কেউ আবারও তারেক রহমানকে 'মিসগাইড' করছে। এর ফলাফল বিএনপির বিপক্ষে যাবে। বিএনপির নীতিনির্ধারকসহ সর্বস্তরের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই মিলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে লন্ডনে তারেক রহমানের দেওয়া বক্তব্যে বিএনপির সর্বস্তরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। দলটির বেশির ভাগ নেতা-কর্মী ওই বক্তব্য সমর্থন করছে না। তাদের মতে, লন্ডনে বসে তারেক রহমানের দেওয়া বক্তব্যে বিএনপি উপকৃত হচ্ছে না। বরং এতে দলের জনপ্রিয়তা আরো কমছে। দল পিছিয়ে যাচ্ছে। এদিকে বিএনপিপন্থী বলে পরিচিত সুধীসমাজের কাছেও তারেক রহমানের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হয়নি। গতকাল বুধবার দিনভর এ প্রশ্নে বিএনপির ভেতরে ও বাইরে তারেকের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বয়েছে। তারেক রহমানের নিজ দল বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত এক ডজন নেতার সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে তাঁর সম্পর্কে নেতিবাচক মূল্যায়নের খবরই বেরিয়ে এসেছে। তবে দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা সম্পর্কে প্রকাশ্যে নেতারা কোনো কথা বলতে রাজি হননি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান ও ব্রিগেডিয়ার জে. (অব.) আ স ম হান্নান শাহসহ দলটির একাধিক নেতার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে রাজি হননি। হান্নান শাহর ভাষ্য হলো, তারেক সাহেব যা বলেছেন এ বিষয়ে তিনিই ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, তারেক সম্পর্কে অনেকে অনেক কিছু বলেন; এটা হয়তো তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এ ধরনের বক্তব্যে বিএনপির লাভ হচ্ছে কি না জানতে চাইলে বিএনপির এই নেতা বলেন, 'এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।' এদিকে বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত সুধীসমাজের প্রতিনিধিরাও তারেকের বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁদের দু-একজন এমন মন্তব্য করেন যে তারেক বিএনপির 'সম্পদ নাকি আপদ' (অ্যাসেট অর লায়াবিলিটিজ)- এ প্রশ্নও আজ নতুন করে উঠতে শুরু করেছে। তাঁদের মতে, সমাজের বড় অংশ এ মুহূর্তে নানা কারণে সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। কিন্তু তারেক রহমানের বিতর্কিত বক্তব্য ও ভূমিকার কারণে তাঁরা বিএনপির প্রতিও সমর্থন ব্যক্ত করতে পারছেন না। পাশাপাশি সমাজের ক্ষমতার বিকল্প বিভিন্ন কেন্দ্র তারেকের ওপর রুষ্ট। ফলে সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হলেও বিএনপিকে তারা সমর্থন দিতে পারছে না। সুধীসমাজের বিএনপিপন্থী প্রতিনিধিদের অনেকে নাম প্রকাশ করেই তারেক সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। গত সোমবার লন্ডনে বিজয় দিবসের এক আলোচনা সভায় তারেক রহমান বঙ্গবন্ধুকে 'রাজাকার ও শখের বন্দি' বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের দল হলে 'আওয়ামী লীগ হত্যার' দায়ে শেখ মুজিবই বড় রাজাকার। বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকালীন দল বটে, তবে মুক্তিযুদ্ধের দল নয়। তারেক আরো বলেন, এটা সবার কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট, মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের বিন্দুমাত্র ভূমিকা ছিল না। বরং ২৫ মার্চ শেখ মুজিব সমঝোতার মাধ্যমে 'শখের বন্দি' হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল তারেক রহমানের এই বক্তব্যকে অগ্রহণযোগ্য, অর্থহীন ও সত্যের অপলাপ বলে উল্লেখ করেন। গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'যে যতভাবে দেখার চেষ্টা করুক না কেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। একই সঙ্গে এটাও বলব- সেক্টর কমান্ডার বা অন্য জাতীয় নেতাদের সম্পর্কেও যেন এ ধরনের বক্তব্য না দেওয়া হয়।' এ ধরনের বক্তব্যে বিএনপি লাভবান হবে কি না জানতে চাইলে আসিফ নজরুল বলেন, মোটেই লাভবান হবে না। লাভবান হওয়ার কারণও নেই। বিএনপিপন্থী বলে পরিচিত সুধীসমাজের প্রভাবশালী আরেকজন প্রতিনিধি ক্ষুব্ধ হয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই খবিশকে নিয়ে মন্তব্য করে আমি কারো রোষানলে পড়তে চাই না। কারণ দেশে তার একটি গুণ্ডাবাহিনী আছে; যারা দেশে সন্ত্রাসীর মতো আচরণ করে।' তিনি বলেন, দেশে কত সমস্যা, কত ইস্যু; অথচ এটা একটা রাজনীতিকের কথা হলো? আওয়ামী লীগবিরোধী বলে পরিচিত এই বুদ্ধিজীবী বলেন, 'শেখ মুজিবের সমালোচনা কি আমরা করিনি? কিন্তু সব কিছুর একটা মানানসই আছে। তিনি ভারতের ইচ্ছায় হোক আর নিজের বুদ্ধিতে হোক; স্বাধীনতা আন্দোলনকে একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর নুরুল আমিন বেপারী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তারেক রহমান যে বক্তব্য বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে দিয়েছেন তা আমি সমর্থন করি না। একই সঙ্গে আমি বিশ্বাস করি, তাঁকে দিয়ে একটি গোষ্ঠী এসব বক্তব্য দেওয়াচ্ছে; যাতে তাঁর ইমেজ নষ্ট হচ্ছে।' তিনি বলেন, 'যাঁর নামে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) এবং যাঁর ডাকে (শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান) দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাঁদের যোগ্য সম্মান দিতে হবে। কিন্তু শুরুটা করেছে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা যখন জিয়াউর রহমানকে আইএসআইয়ের এজেন্ট বলে গালি দেন, তখনই বিএনপির পক্ষ থেকে এসব বক্তব্য আসছে।' যাঁর যাঁর প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার দাবি জানিয়ে প্রফেসর নুরুল আমিন বলেন, 'আমেরিকায় জাতির পিতা অনেকজন। তাদের তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না! তাহলে আমাদের এখানে সমস্যা কেন? কারণ মওলানা ভাসানীর মতো নেতাদের সম্মান দেওয়া হয় না।' তারেক রহমানকে সহনশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরো বলেন, আগামীর বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে হলে তারেক রহমানকে আরো সহনশীল হয়ে নিজেকে তৈরি করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'তারেক রহমান বিদেশে বসে কী অবস্থায় ও প্রেক্ষিতে এসব বলছে না জেনে মন্তব্য করা যাবে না।' তবে তিনি স্বীকার করেন, দেশে এখন অনেক সমস্যা। রাজনৈতিক বিতর্কের চেয়ে সেসব ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ। লন্ডনের আলোচনা সভায় উপস্থিত বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ দেশে ফেরার পর তাঁর কাছ থেকে সব জেনে এ বিষয়ে নিজের মতামত দেবেন বলে জানান ঢাবির সাবেক এই অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এর আগেও লন্ডনে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একাধিকবার আপত্তিকর মন্তব্য করে আলোচিত-সমালোচিত হন তারেক রহমান। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের ভেতরে ও বাইরে কখনোই তাঁর এ সম্পর্কিত বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হয়নি। বরং শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সবারই মত, তারেকের বক্তব্যে বিএনপির জনসমর্থন 'মাইনাসে'র দিকে যাচ্ছে। তাঁদের মতে, এতে লাভবান হচ্ছে একটি মাত্র দল; সেটি হলো- জোটের অন্যতম প্রধান শরিক জামায়াত। বিএনপির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের দাবি, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর সম্পর্কে জামাতা এক ব্যারিস্টারের সঙ্গে ইদানীং তারেক রহমানের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে এবং তাঁর পরামর্শেই তারেক রহমান এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকতে পারেন বলে অনেকের সন্দেহ। এ ছাড়া জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকও গ্রেপ্তার এড়াতে এখন লন্ডনে বসবাস করছেন। একটি সূত্রের দাবি, তিনিও সুযোগ পেলে লন্ডনে তারেকের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা করতে যান। অনেকের সন্দেহ, তিনিও প্ররোচনা দিতে পারেন। এ ছাড়া লন্ডনে তরুণ এক দল আইনজীবী, কিছু সাংবাদিক ও হাওয়া ভবনের সাবেক কিছু কর্মকর্তা বর্তমানে তারেক রহমানকে ঘিরে আছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক বিষয়ে নিজেকে গবেষক বলে দাবি করেন। বিএনপির ঢাকার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ওই ব্যক্তিদের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত বলে জানা যায়। অনেকের সন্দেহ, তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ তারেক রহমানকে বিপথে নিয়ে যাওয়ার মতো পরামর্শ দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে তারেক রহমান বিএনপিকে এগিয়ে নয় বরং পিছিয়ে দিচ্ছেন বলেই মনে করা হচ্ছে খোদ বিএনপি থেকেই।  

No comments:

Post a Comment