দেশে টেলিযোগাযোগ সেবাদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে রাজস্ব, লাইসেন্স ফি ও অন্যান্য পাওনা আদায় নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। গত সেপ্
টেম্বর পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে বিটিআরসির পাওনার পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৭৭১ কোটি টাকার ওপরে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) এবং টেলিটকের কাছেই শুধু পাওনা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ২২৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। কিন্তু বারবার তাগাদা দিয়েও বিটিআরসি এই বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় করতে পারছে না। বরং যত দিন যাচ্ছে পাওনার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। টাকা আদায়ে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে এবং মামলা করেও কোনো সুফল আসছে না। এই পরিস্থিতিতে বিটিআরসি সরকারকে আগেভাগেই জানিয়ে দিতে চায় যে, বকেয় রাজস্ব আদায় না হলে টেলিযোগাযোগ খাত থেকে চলতি অর্থবছরের আর্থিক বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান দুটির কাছ থেকে রাজস্ব আয়ের সমস্যা কতটা প্রকট তা-ও জানিয়ে রাখতে চায় বিটিআরসি। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত বিটিআরসির ১৭৫তম সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রসঙ্গত, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বার্ষিক হিসাব বিবরণী নিরীক্ষা করে বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল- সিএজি) পক্ষ থেকে গত ২৪ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও এ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ওপর তৈরি করা দুটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনের একটিতে ২১টি আপত্তির বিপরীতে দুই হাজার ৬২৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা এবং অন্যটিতে ১৭টি আপত্তির বিপরীতে ৪৮ কোটি ৩২ লাখ টাকার অনিয়ম পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়। এসব অনিয়মের মধ্যে অন্যতম ছিল বিভিন্ন টেলিফোন কম্পানির কাছ থেকে স্পেকট্রাম চার্জ অনাদায়, এয়ারটাইম চার্জের বকেয়া ফি ও রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের বকেয়া আদায় না করা। সংবাদ সম্মেলনে সিএজির পক্ষ থেকে বিটিআরসিতে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে বলে দাবি করা হলেও এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস ২৫ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য সংবাদমাধ্যমে সঠিকভাবে আসেনি। ওই সংবাদ সম্মেলনে ২০১১ সালের পরের তিন বছরে এই অনিয়ম বা বকেয়া রাজস্ব আদায়ে বিটিআরসির ব্যর্থতা বা দায়িত্বহীনতা বেড়েছে না কমেছে- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নে সুনীল কান্তি বোস স্পষ্ট কোনো জবাব দেননি। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিটিআরসির সর্বশেষ সভায় যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে বিটিআরসির ব্যর্থতা এবং দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের অরাজক পরিস্থিতি এবং কিছু ক্ষেত্রে দুর্দশার চিত্রই উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোসের সভাপতিত্বে ওই সভায় ভাইস চেয়ারম্যান ব্রি. জে. মো. আহসান হাবিব খান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে আনাদায়ী রাজস্বের পরিমাণ, এ বিষয়ে বিটিআরসির পদক্ষেপগুলোর কথা উল্লেখ করেন। বিটিআরসির সর্বশেষ সভায় সরকারি এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের বকেয়া পরিশোধের জন্য এক মাস সময় দিয়ে ওই সময়ের মধ্যে সমস্যার সমাধান না করলে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বকেয়া পরিশোধে ১৫ দিন করে সময় দেওয়া হয় এবং তা না করলে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব ও বিটিসিএল ও টেলিটকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মো. ফায়জুর রহমান চৌধুরী তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান দুটি সম্পর্কে বিটিআরসির এসব অভিযোগ ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে গতকাল সোমবার রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বকেয়ার যে হিসাব দেওয়া হয়েছে তা সঠিক কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিটিসিএল ও টেলিটকেরও ওই বকেয়া সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে। আমরা বিটিআরসির চিঠি এখনো পাইনি। পেলে বিটিআরসির সঙ্গে প্রতিষ্ঠান দুটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে আমরা বসব।' কার কাছে কত পাওনা : বিটিআরসির তথ্যানুসারে বিটিসিএলের কাছে ২০০৮ সালের অক্টোবর থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ এক হাজার ৬১৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা বকেয়া পড়েছে। এই ছয় বছরে বিটিআরসির কাছে বিটিসিএলের বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় আইজিডাব্লিউ অপারেটর হিসেবে দুই হাজার ৪৩৫ কোটি ৪৬ লাখ, আইসিএক্স অপারেটর হিসেবে ৪৬৪ কোটি ১৫ লাখ ও পিএসটিএন অপারেটর হিসেবে মোট ১৯৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আইজিডাব্লিউর এক হাজার ৪৮১ কোটি টাকা পরিশোধ করে। রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল অপারেটর টেলিটকেরও একই দশা। এ প্রতিষ্ঠানের কাছে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিটিআরসির পাওনার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক হাজার ৬১৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ ১৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল (এসওএফ) ১৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা এবং থ্রিজি মোবাইল সেবার স্পেকট্রাম অ্যাসাইনমেন্ট ফি বাবদ প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির এক হাজার ৫৮৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। অন্যান্য বেসরকারি পিএসটিএন অপারেটরের কাছে বিটিআরসির পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে মোট ১২টি পিসটিএন অপারেটরের লাইসেন্স ফি বাবদ ২৪ কোটি ১৩ লাখ, স্পেকট্রাম চার্জ বাবদ ৮ কোটি ৫৫ লাখ এবং গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ তিন কোটি ২২ লাখ টাকা। এসব পিএসটিএন অপারেটরের মধ্যে ৯টির কোনো কার্যক্রমও নেই। মোবাইল ফোন অপারেটর পিবিটিএল বা সিটিসেলের কাছে বিটিআরসির পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫২ কোটি ৫৩ লাখ টাকার কাছাকাছি। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ আট কোটি ২৩ লাখ, স্পেকট্রাম চার্জ বাবদ ৯ কোটি ৮৭ লাখ, সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল বাবদ পাঁচ কোটি ৪৩ লাখ, টুজি মোবাইল সেবার স্পেকট্রাম অ্যাসাইনমেন্ট ফি বাবদ ২২৯ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। ব্রডব্যান্ড ওয়্যারলেস অ্যাকসেস (বিডাব্লিউএ) বা ওয়াইম্যাক্স অপারেটর বাংলালায়নের কাছে বিটিআরসির পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকার কাছাকাছি। বেসরকারি ১৬টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে বা আইআইজি অপারেটরের কাছে রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ পাওনার পরিমাণ ১০ কোটি টাকার ওপরে। এ ছাড়া তাঁদের কাছে লাইসেন্স ফির টাকাও পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে ম্যাংগো টেলিসার্ভিসেসের কাছেই রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাওনা রয়েছে আট কোটি ২৬ লাখ টাকা। ইন্টারকানেকশন একচেঞ্জ বা আইসিএক্স অপরেটরদের কাছে রেভিনিউ শেয়ারিং ও লাইসেন্স ফি এবং মূসক বাবদ পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩০ কোটি ৬৮ লাখ টাকার কাছাকাছি। ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে বা আইজিডাব্লিউ অপারেটরদের কাছে রেভিনিউ শেয়ারিং, লাইসেন্স ফি এবং মূসক হিসেবে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬৬৯ কোটি ১৭ লাখ টাকার কাছাকাছি। এর মধ্যে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া ছয়টি আইজিডাব্লিউর কাছে পাওনার পরিমাণ মোট ৫৮৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
No comments:
Post a Comment