Sunday, December 14, 2014

পুনর্বাসনের নামে শিশুদের ধরপাকড়:প্রথম অালো

টেনেহিঁচড়ে এক বাচ্চা মেয়েকে ওঠানো হচ্ছে মাইক্রোবাসে। ‘বাঁচান, বাঁচান’ বলে হাউমাউ করে কাঁদছে মেয়েটি। মেয়েটিকে মাইক্রোবাসে ওঠানোর পর দেখা গেল, ভেতরে আগে থেকেই ওঠানো আরও ছয়-সাতজন শিশু হাউমাউ করে কেঁদেই চলছে।  গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এভাবেই হঠাৎ করেই শিশুদের ধরপাকড় শুরু হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা পরিচয়ে কয়েকজন লোকের সঙ্গে ধরপাকড়ে অংশ নেয় পুলিশও। কিন্তু এভাবে শ
িশুদের ধরে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদ করে স্থানীয় জনতা। খবর পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসেন স্বজনেরাও। প্রবল প্রতিবাদের মুখে মাইক্রোবাস থেকে শিশুদের বের করে আনার পর ক্ষুব্ধ জনতা সেটি ভাঙচুর করে। চরম তোপের মুখে পড়ে পুলিশ ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া লোকজন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, একটা বাচ্চা মেয়েকে টেনেহিঁচড়ে মাইক্রোবাসে তোলা হচ্ছে। মাইক্রোবাসে তখন পোশাকধারী অস্ত্রধারী চার-পাঁচজন পুলিশ। পরিচয় দিয়ে ঘটনার কারণ জানতে চাইলে ধরপাকড় করা এক ব্যক্তি জানান, তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ভবঘুরে পথশিশুদের পুনর্বাসন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই ওই শিশুদের ধরে তাঁরা মিরপুরে পুনর্বাসনকেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জানান, ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় এভাবে চারটা দল এ ধরনের ধরপাকড়ের কাজ করছে। এমন সিদ্ধান্তের কোনো বৈধ কাগজ চাইলে ওই ব্যক্তি তা দেখাতে পারেননি। ওই ব্যক্তি দাবি করেন, মাইক্রোবাসে ওঠানো শিশুদের মা-বাবা নেই। তারা ভবঘুরে। খাবার-দাবার, শিক্ষা ও শীতের পোশাকের নিশ্চয়তার জন্য তাদের পুনর্বাসনকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ‘এভাবে টেনেহিঁচড়ে কেন?’ প্রশ্ন করলে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘কোনো উপায় নাই।’ এসব আলাপচারিতার মধ্যেই মাইক্রোবাসের ভেতর থেকে শিশুরা কাঁদতে কাঁদতে এই প্রতিবেদককে বলছিল, ‘ভাই, আমাদের বাপ-মা আছে। আমাদের বাঁচান।’ কিছুক্ষণ পর এক শিশুর অভিভাবক দাবি করে ছুটে আসেন একজন নারী। সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচয় দেওয়া এক কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘দালাল কোথাকার, যাও।’ ততক্ষণে মাইক্রোবাসটির চারদিকে ভিড় জমে যায়। এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে আসেন একটি শিশুসংগঠনের কর্মকর্তা। তিনি মাইক্রোবাস থেকে শিশুদের বের করে আনার চেষ্টা করেন। শেষমেশ ব্যর্থ হয়ে তিনি মাইক্রোবাসটির সামনে গিয়ে ভাষণের মতোই বলতে থাকেন, ‘এভাবে আমাদের শিশুদের নিয়ে যেতে দেব না।’ ক্ষুব্ধ জনতা তখন ওই মাইক্রোবাসটি ঘিরে ধরে। তারা ‘ভুয়া’ ‘ভুয়া’ বলে চিৎকার করে পুলিশের ওপর চড়াও হয়। পুলিশ মাইক্রোবাসের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। হট্টগোলের মধ্যেই সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া একজন এই প্রতিবেদককে জানান, এ শিশুদের মা-বাবা নেই। অনেক লোক তাদের দিয়ে কারওয়ান বাজারে ব্যবসা করায়। এ কথার প্রতিবাদ করে ওঠেন বাবু নামের এক যুবক। তিনি জানান, মাইক্রোবাসে তাঁর ভাগনি নাজমাকে ওঠানো হয়েছে। নাজমার বাবার নাম ইসমাইল। তিনি সেগুনবাগিচায় থাকেন। তরকারি খুঁজতে কারওয়ান বাজারে এসেছে নাজমা। মাইক্রোবাসের ভেতরে তখন পর্যন্ত কেঁদেই যাচ্ছিল নাজমা নামের মেয়েটি। সে তার বাবার নাম ইসমাইল বলেই জানায়। ভেতরে থাকা অন্য শিশুরা হলো: ঝর্না, আনোয়ারা, আশরাফুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম, নাইম, জাহিদ ও বাপ্পী। এসব কথাবার্তার মধ্যেই একপর্যায়ে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন স্বজন ও স্থানীয় লোকজন। তাঁরা মাইক্রোবাসের দরজা খুলে ভেতর থেকে শিশুদের বের করে আনেন। তার পরও জনতা আটকে রাখে মাইক্রোবাসটি। তারা পুলিশ, সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচয় দেওয়া লোকজনের পরিচয়পত্র দেখতে চায়। জানতে চাইলে এক পুলিশ সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে এসেছেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের আদেশ মানতে এসেছেন তাঁরা। তবে এ ধরনের অভিযানের ব্যাপারে জানে না তেজগাঁও থানার পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের অভিযান সম্পর্কে আমি জানি না। পুলিশ পাঠাচ্ছি।’ কিছুক্ষণ পর তেজগাঁও থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে মাইক্রোবাসে থাকা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন। তখনো আশপাশে জনতার ভিড়। পুলিশ তাদের শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে মাইক্রোবাস নিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এরই মধ্যে জনতার ভেতর থেকে একজন মাইক্রোবাসের কাচ ভেঙে দেয়। পরে আরও অতিরিক্ত পুলিশ এসে মাইক্রোবাসসহ পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালকের (প্রশাসন) দায়িত্বে থাকা আইয়ুব হোসেন প্রথম আলোকে জানান, পথশিশুদের পুনর্বাসনের বিষয়ে তাঁদের একটি কর্মসূচি রয়েছে। তবে কাউকে জোর করে নয়। মা-বাবা থাকলে কাউন্সেলিং করা হয়। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পুনর্বাসন করা হয়। তবে কারওয়ান বাজারের ঘটনাটি তিনি জানেন না।

No comments:

Post a Comment