Monday, January 26, 2015

ভেজা চোখে সেবা বার্ন ইউনিটে:কালের কন্ঠ

চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কতগুলো রোগের চিকিৎসা সুবিধা বা ব্যবস্থা আছে তা কতজনই বা জানে। কোথাও ৩০-৩৫টি কোথাও বা ১৮-২০টি। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অবকাঠামো অনুযায়ী থাকে সুযোগ-সুবিধাগুলো। মেডিসিন, সার্জারি, অর্থপেডিক্স, গাইনি, নাক-কান-গলা, ক্যান্সার ইউনিট আরো কত কী। তবে সব ছাপিয়ে এখন দেশ-বিদেশে সবার কাছে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বার্ন ইউনিট। বিশেষ করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট। এমন পরিচিতি
নিয়ে গর্ব থাকার কথা। কিন্তু এ ইউনিটের চিকিৎসক-নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনে এ নিয়ে নেই বিন্দুমাত্র আনন্দের রেশ। বরং দগ্ধদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে কঠোর পেশাদারির মধ্যেও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তাঁরা, চোখ ভিজে ওঠে, কারো কারো বুকের ভেতর জমতে থাকে ক্রোধ, হাহাকার। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পালের কণ্ঠেও পাওয়া গেল সেই হাহাকার আর কষ্টের অনুরণন। বলেন, 'সাধারণ অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনায় পুড়ে যাওয়া মানুষের সেবা দেওয়ার অনুভূতি এক রকম, আর রাজনীতির শিকার হওয়াদের সেবা দিতে গিয়ে হয় ভিন্ন অনুভূতি। একেকজন দগ্ধ মানুষকে দেখে নিজের ভেতরটাও পুড়তে থাকে। প্রাণপণ চেষ্টা করি তাদের বাঁচিয়ে তুলতে, কিন্তু অনেককেই শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায় না। এর চেয়ে কষ্টের আর কিছুই হতে পারে না।' রাজনীতির জন্য নিরপরাধ মানুষকে এমন পরিকল্পিতভাবে পুড়িয়ে যারা হাসপাতালে পাঠায় তাদের প্রতি ঘৃণা আর ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে চিকিৎসকদের মনে। তবে একদিকে চাকরি, অন্যদিকে দায়িত্বের আড়ালে চাপা দিয়ে রাখতে হয় সেই আবেগ। অনেকেই চিকিৎসার ফাঁকে ফাঁকে চোখের পানি মুছে নেন বার বার। অগ্নিদগ্ধ মানুষের চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা নিয়েও হতাশা-আক্ষেপের কমতি নেই দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের মধ্যে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের একাধিক চিকিৎসক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা পোড়া মানুষকে চিকিৎসা দিই, কিন্তু তাদের সবার সব প্রয়োজন মেটাতে পারি না। অনেক গরিব মানুষেরই চিকিৎসার খরচ চালানোর উপায় থাকে না, কিন্তু আমাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। সরকারিভাবে সবটুকু ব্যয় বহন করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। সরকারের উচিত এ দিকটায় আরো বেশি নজর দেওয়া।' কেবল রোগীদের খরচই নয়, বার্ন ইউনিটের ব্যবস্থাপনা এবং সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা আছে। বিশেষ করে চলমান সহিংস রাজনীতির শিকার হয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে অগ্নিদগ্ধ মানুষের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। কিন্তু সেদিকে নজর নেই সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। চূড়ান্ত কিছু অনুমোদন প্রক্রিয়া এখনো ঝুলে আছে মন্ত্রণালয়ে। প্রক্রিয়াধীন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এমন পরিস্থিতির মুখে এখন সবার নজর এই ইউনিটের দিকে, কিন্তু অন্য সময় এর গুরুত্ব বুঝতে চান না অনেকেই। আমরা বছরের পর বছর দৌড়ঝাঁপ করলেও তাঁদের টনক নড়ে না।' ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট প্রাথমিক অনুমোদন পেলেও এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন মেলেনি। এটি এখন আটকে আছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। এই জটিলতা মিটলে শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই অগ্নিদগ্ধ মানুষের চিকিৎসায় আরো গতি আসবে। দেশের অন্যান্য এলাকায়ও কেউ দগ্ধ হলে আর তাদের ঢাকায় ছুটে আসতে হবে না। স্থানীয় পর্যায়েই ঢাকার মতো উন্নত চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাবে সেখানে। ডা. সামন্ত লাল বলেন, এখন কেবল ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, কুমিল্লা ও খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিট আছে। বাকি কোথাও প্রশিক্ষিত জনবল ও ব্যবস্থাপনা নেই। কিন্তু ইনস্টিটিউট করা গেলে সব কিছুই থাকবে। বার্ন ইউনিট গঠনের বিষয়ে জানাতে গিয়ে ডা. সামন্ত লাল বলেন, 'আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে ১৯৭১-৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে প্রতিবন্ধী মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ডা. আর জে গাস্ট বাংলাদেশে আসেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থোপেডিক সার্জন। পরে তিনি প্রয়োজনের তাগিদে ভারতের লুদিয়ানা থেকে ভারতীয় প্লাস্টিক সার্জন ডা. পারভেজ বেজলীলকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কাজ করার জন্য নিয়ে আসেন। এর থেকেই শুরু বাংলাদেশের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির ইতিহাস। বাংলাদেশের প্লাস্টিক সার্জন প্রয়াত অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ আশির দশকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যোগ দেন। তাঁরই একান্ত প্রচেষ্টায় একদল চিকিৎসক যুক্ত হন, যাঁদের মধ্যে ছিলাম আমি, ডা. সামসুদ্দিন, অধ্যাপক কবির উদ্দিন, ডা. সালেক, ডা. শহীদুল বারী, ডা. আশরাফুজ্জামানসহ আরো অনেকে। সবার সহযোগিতায় বাংলাদেশে শুরু হয় আলাদাভাবে বার্ন ইউনিট প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬ সালে অধ্যাপক শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে আলাদা একটি বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট শুরুর আবেদন জানানো হয় সরকারের কাছে। শেষ পর্যন্ত ২০০৩ সালে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট বার্ন ইউনিট আলাদা জায়গায় নতুন ভবনে যাত্রা শুরু করে। এখন এ ইউনিটে বেড সংখ্যা ১০০। মোট চিকিৎসক আছেন ৩১ জন, যাঁদের মধ্যে সরকার অনুমোদিত চিকিৎসক মাত্র ৯ জন। অন্যরা প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া আছেন ৭১ জন নার্স ও ১৬ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী। এই লোকবল নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ইউনিট পরিচালনা রীতিমতো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডা. সামন্ত লাল আরো জানান, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিবছর আনুমানিক ছয় লাখ মানুষ বিভিন্ন কারণে দগ্ধ হয়, যাদের বেশির ভাগই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও রোগী আসে এখানে। বার্ন ইউনিটে এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ যুক্ত হয়েছে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি কোর্সও চালু হয়েছে। ফলে চিকিৎসার মান অনেক বেড়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ১৪টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে মোট ৯৮টি বিভিন্ন স্তরের পদ সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী ও বগুড়ায় বিশেষজ্ঞ সার্জন পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩০ শয্যার বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট চালু হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক পদমর্যাদার ২৩ জন বিশেষজ্ঞ আছেন, যাঁদের প্রত্যেকের ইউনিট চালানোর দক্ষতা আছে। স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরাও নতুন বিশেষজ্ঞ সার্জন হিসেবে কাজ শুরু করতে পারবেন।      

No comments:

Post a Comment