সরকারি চাকরিজীবীরা সবাই কর্মকর্তা হতে চান। কেউ কর্মচারী থাকতে চান না। অথচ বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী তাঁরা সবাই কর্মচারী। কর্মচারীদের কর্মকর্তা হওয়ার মানসিকতায় পেয়ে বসলেই সেবা করার মানসিকতা পালিয়ে যায়। তাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কর্মচারী হিসেবেই কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে। গতকাল রবিবার সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। এ সময় তিনি সরকারি কর্
মচারী আইন প্রণয়নে বিলম্বের কারণ জানতে চান। এ ছাড়া কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ, গবেষণা, ঢাকাকে ভাগ করে নতুন বিভাগ সৃষ্টিসহ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ভাবনা জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের সামনে তুলে ধরেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য জানান। মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, কর্মচারীদের কর্মকর্তা হওয়ার খায়েশ ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। নিজেদের পদবিতে কর্মকর্তা তকমা সংযোজন করার জন্য তাঁরা প্রশাসনকে বাধ্য করেন। কর্তৃপক্ষকে হুমকি-ধমকিসহ কর্মবিরতি পালন করে কর্মচারীরা তাঁদের পদপদবির নাম পরিবর্তন করছেন। সবচেয়ে সম্মানিত পদবির একটি হচ্ছে বিজ্ঞানী। অনেক গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরাও তাঁদের পদবির সঙ্গে কর্মকর্তা যোগ করার জন্য আন্দোলন করছেন। সচিবালয়ে টেলিফোন অপারেটররাও কর্মকর্তা বনে গেছেন। সম্প্রতি কর্মকর্তা হওয়ার জন্য সারা দেশের ডিসি অফিসের কর্মচারীরা জোট বেঁধে আন্দোলনে নেমেছেন। শুধু ডিসি অফিস নয়, সর্বত্র একই অবস্থা। এ প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি কর্মকর্তাদেরও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর মতো আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন গতকালের সভায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রশাসনকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি নীতি প্রণয়ন করতে চায়। ঢাকা বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'এটি ১৭টি জেলার সমন্বয়ে সব থেকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে প্রশাসন চালানো কঠিন। মানুষকে সত্যিকারভাবে সেবা দিতে গেলে, উন্নয়ন করতে চাইলে সবচেয়ে ভালো হতো যদি আমরা ঢাকাকে তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারি।' তবে ঢাকাকে ভেঙে তৃতীয় কোন বিভাগ হতে পারে সে বিষয় স্পষ্ট করেননি তিনি। বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য কোনো আইন নেই। মন্ত্রণালয়ের বিধিবিধান দিয়ে কর্মচারীদের পরিচালনা করা হয়। এ-সংক্রান্ত সরকারি কর্মচারী আইন করার জন্য ছয় বছর ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করে আইনের খসড়া করা হয়েছে। আইন প্রণয়নের জন্য ইউএনডিপির সহায়তা নেওয়া হয়েছে। সেই খসড়া আইনের খোঁজ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারি কর্মচারী আইন কোথায়? এ সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী প্রস্তাবিত আইনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবিত আইন সম্পর্কে কর্মকর্তাদের বলেন, সরকারি কর্মচারী আইন প্রণয়ন করতে হবে। প্রস্তাবিত আইনে যদি কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে তা সংশোধন করা যাবে। বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগদানের পর মাত্র চার মাসের প্রশিক্ষণ নেন। অথচ একসময় এ প্রশিক্ষণ ছিল দুই বছরের। এর মধ্যে এক বছরের প্রশিক্ষণ ছিল একাডেমিক প্রশিক্ষণ। ছয় মাসের প্রশিক্ষণে পাঠানো হতো বিদেশে। অবশিষ্ট ছয় মাস প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। মোট দুই বছরের প্রশিক্ষণ শেষে ক্যাডার কর্মকর্তাদের পোস্টিং দেওয়া হতো। বর্তমানে প্রশিক্ষণের আগেই পোস্টিং দেওয়া হয়। আর প্রশিক্ষণ হয় মাত্র চার মাসের। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে গবেষণাও বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, স্বাধীনতার পর কৃষি গবেষণায় বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল বলেই খাদ্য উৎপাদন তিন গুণ বেড়েছে। গবেষণা করে বের করতে হবে জনপ্রশাসনের সমস্যা কী। প্রধানমন্ত্রী জনপ্রশাসনের ভঙ্গুর অবস্থার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু বদলে দেওয়া হয়। কমিউনিটি ক্লিনিক দিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র বদলে দেওয়া সম্ভব। অথচ আওয়ামী লীগ সরকার বদলের পর ২০০১ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী সময়ের সঙ্গে সংগতি রেখে আইন ও বিধিবিধান পরিবর্তনের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, কর্মকর্তাদের দক্ষ ও গতিশীল করতে এবং তাঁদের যোগ্যতা বিকাশে ২০০৩ সালের বেসামরিক কর্মকর্তা প্রশিক্ষণনীতি পরিবর্তন করতে হবে। সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের একসঙ্গে প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা করতে তিনি এনডিসি চালু করেন। কিন্তু আমাদের বেসামরিক কর্মকর্তারা সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী নন- এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর গুরুত্ব বুঝে কর্মকর্তাদের এ কোর্স সম্পন্ন করা উচিত। বর্তমানে প্রশাসনে পদোন্নতি নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। পদের চেয়ে অনেক বেশি কর্মকর্তা থাকার পরও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী গতকাল বলেছেন, প্রশাসনে প্রচুর শূন্যপদ রয়েছে। একদিকে শূন্যপদ, অন্যদিকে প্রমোশনের জায়গা নেই। এ অবস্থা চলতে পারে না। কাজেই বিসিএস নিয়োগপ্রক্রিয়া দ্রুত করেন। পাশাপাশি পদোন্নতিও দিতে হবে। প্রয়োজনে নতুন নীতিমালা করতে হবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান, পদ সৃজনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এত দীর্ঘ সময় লাগে কেন? জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে পদ সৃজনের যে প্রস্তাব আসে তা পূর্ণাঙ্গ নয়। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব মন্ত্রণালয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তারাই এসব বিধিবিধানের কাজ করেন। তাহলে এ ধরনের সমস্যা থাকবে কেন? পদ সৃজনের প্রস্তাবনায় কী কী বিষয় থাকতে হবে তার তালিকা তৈরি করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি নিয়োগপ্রক্রিয়া আরো সহজ এবং জোরদারে বিশেষ করে শিক্ষক, চিকিৎসক ও পুলিশের নিয়োগে বিভিন্ন উইং খোলার ওপর জোর দেন। সরকার ৫০ হাজার পুলিশ সদস্য নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি এ প্রক্রিয়া জোরদারের জন্য পিএসসিকে নির্দেশ দেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে একটি পদ সৃজন ও নিয়োগে প্রায় সাত বছর সময় লাগে। অথচ সরকারের মেয়াদ হচ্ছে পাঁচ বছরের। উদ্যোগ নেওয়া হলেও সরকারের পক্ষে জনবল নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয় না। জনপ্রশাসনকে দেশের হৃৎপিণ্ড হিসেবে অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রশাসনের স্বচ্ছন্দ গতির জন্য সরকার সম্পূর্ণভাবে এ মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীল। এ জন্য এটি সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন হলো বেসরকারি প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। নিয়োগ-বদলি, প্রমোশন, প্রশাসনিক ক্ষেত্রের ব্যবস্থাপনা, সংস্কার, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং আরো অনেক কার্যক্রম এ মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সিদ্দিকী ও সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। এ সময় মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
No comments:
Post a Comment