Monday, January 19, 2015

সতর্কতা, তবু আক্রান্ত পুলিশ:কালের কন্ঠ

টানা অবরোধ ও হরতালে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পরিশ্রান্ত পুলিশ। এর ওপর আন্দোলনকারীদের আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে দফায় দফায়। এ অবস্থায়ও সশস্ত্র পুলিশ সদস্যদের 'সংযত' আচরণ কুড়াচ্ছে প্রশংসা। চোরাগোপ্তা হামলার পাল্টা জবাব দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা গত রাত পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন অনেকটা কৌশলে। কার্যত পুলিশের কোনো বেপরোয়া আচরণ সরকারের জন্য নতুন 'বিব্রতকর' পরিস্থিতি যেন
তৈরি না করে সেদিকেই নজর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। তাই কঠোর হলেও কৌশলে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। গত শনিবার রাতে ঢাকায় মৎস্য ভবনের সামনে পুলিশের একটি বাসে পেট্রলবোমা ছোড়া হলে পাঁচ পুলিশ সদস্য দগ্ধ হন। এ ঘটনার পর পুলিশ সদস্যরা সতর্ক হলেও বেপরোয়া কোনো আচরণ করেননি। বাড়তি সতর্কতার অংশ হিসেবে ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় একা চলতে তাঁদের মানা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। টহল ও চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকালে নানা রকম কৌশল অবলম্বনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি আসামি গ্রেপ্তার ও অপরাধীদের ধাওয়া করার সময় পুরো টিম নিয়ে অগ্রসর হওয়ার জন্য বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। একেবারে নিরুপায় না হলে অস্ত্র ব্যবহার না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট রাষ্ট্রের সম্পদ এবং মানুষের জীবন নষ্ট করছে। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও হামলা চালাচ্ছে। তবে পুলিশের ওপর হামলা করে তাদের মনোবল নষ্ট করতে পারবে না। অতন্দ্র প্রহরীর মতো পুলিশ রাষ্ট্রের জন্য কাজ করছে। জাতি তাদের স্মরণ রাখবে সব সময়। পুলিশ সদস্যরা নির্বিঘ্নে তাঁদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের সাবধানে থেকে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। তবে কেউ যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা চালায় তাদের রক্ষা নেই। মাঠপর্যায়ের বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের ধারণা, বিচ্ছিন্নভাবে হামলা করে আন্দোলনকারীরা পুলিশের মনোবল ভাঙার চেষ্টা করছে। এর আগেও পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে আন্দোলনকারীরা। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। সে ক্ষেত্রে পুলিশ নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হলে বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। সে ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থানে থেকে অপরাধ প্রতিহত এবং অপরাধী গ্রেপ্তার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সবাইকে সতর্কভাবে চলাফেরা ও দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। বগুড়া থেকে ঢাকায় কাজে আসা একজন নারী এএসপি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'রাস্তায় সতর্কতার জন্য ইউনিফর্ম খুলে আসতে হয়েছে। পরে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে পৌঁছে ইউনিফর্ম পরেছি। আর ডিউটিরত অবস্থায় সবাইকে এখন হেলমেট ও লেগগার্ড পড়ে থাকতে হচ্ছে।' পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সারা দেশে পুলিশ আছে প্রায় এক লাখ ৫৫ হাজার। ৫ জানুয়ারি থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ চলায় দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা ও সহিংসতা ঘটছে। এ অবস্থায় প্রায় পুরো জনবলকেই কাজে লাগাতে হচ্ছে একই সময়ে। আর তাতে টানা দায়িত্ব পালনে কিছুটা ক্লান্ত হলেও মিলছে না ছুটি। পুলিশের কাজে সহায়তার জন্য বিজিবি ও র‌্যাব মাঠে নামানো হলেও পুলিশের কাজে কমতি নেই। যখন যেখানে প্রয়োজন তখনই ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হচ্ছে। পুলিশ সদস্যরা জানান, আন্দোলনের কারণে পুলিশের সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এর ওপর আট ঘণ্টার স্থলে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে ১৮ ঘণ্টা। বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ মিলছে না কারো। এ জন্য বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছেন না পুলিশ সদস্যরা। উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পুলিশের অস্ত্র জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। আমরা রাষ্ট্রের জন্য যা যা করা দরকার তাই করছি। তবে থানার ওসিদের ডিউটির নির্ধারিত কোনো সময় নেই। থানা এলাকায় কোনো ঘটনা ঘটলে আমাদের ছুটে যেতে হয়। তাই ২৪ ঘণ্টাই আমাদের ডিউটি। অন্য সময় বিশ্রামের কিছুটা সময় পাওয়া যেত। কিন্তু এখন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কাজের চাপ বেড়ে গেছে।' পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, এ মুহূর্তে অসুস্থতাজনিত কারণ ছাড়া পুলিশের কাউকে ছুটি দেওয়া হচ্ছে না। ডিউটি করাকালে সবাইকে সাবধানে থাকতে বলা আছে। রাজধানীর কয়েকটি থানার ওসিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২৪ ঘণ্টাই তাঁদের সতর্ক থাকতে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় বিশ্রামের সময়টুকুও পাওয়া যাচ্ছে না। থানার এসআই, এএসআই, হাবিলদার, কনস্টেবলসহ সবাইকে প্রায় ১৮ ঘণ্টা করে ডিউটি করতে হচ্ছে। উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ছাড়াও মামলার তদন্ত, টহল, তল্লাশি, আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাওয়া, আসামি ধরাসহ আনুষঙ্গিক কাজ করতে হচ্ছে। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি অবনী শংকর কর জানান, অবরোধ ডাকার পর থেকে কাজের চাপ বেড়ে বহুগুণ। থানার ওসি তদন্ত, ৬২ জন এসআই ও এএসআই, ৭০ জন কনস্টেবল এবং আরো প্রায় ৭০ জনের বেশি আনসার সদস্যকে দিনরাত ডিউটি করতে হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে ২০০ রিজার্ভ ফোর্স থানা এলাকায় ডিউটি করছে। এর ফাঁকেও অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরসহ ফৌজদারি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হয়। এদিকে সহিংসতা ও নাশকতা মোকাবিলায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবারের সদস্যরা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের ছাত্রী আয়েশা সিদ্দীকা কণা জানিয়েছেন, তাঁর স্বামী পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ লাইনে কর্মরত। জান্নাতুত তাহসীন নামে তাঁদের চার বছর বয়সী মেয়ে আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বামী জহিরের 'কখন কী হয়ে যায়'- এই আশঙ্কায় দিনরাত কাটে স্ত্রী কণার। দিন কয়েক আগে কালের কণ্ঠে পাঠানো ই-মেইল বার্তায় তিনি জানান নানা উদ্বেগের কথা।

No comments:

Post a Comment